ফয়সল আহমদ রুহেল::
পাকিস্তানী শাসকরা হঠাৎ এদেশের মানুষের উপর এক অসম যুদ্ধ চালিয়ে দিয়েছিল। জাতি হিসেবে সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল এদেশের দামাল ছেলেরা। মো. আতাউর রহমান দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যোগ দেন দেশ মাতৃকার মুক্তির এ লড়াইয়ে। দেশ স্বাধীন হয়। ২য় পর্বে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করার পর আর্থিক অনটন। কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। বাবার সাথে কৃষি কাজ করতে হয়। জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পার করতে হয়। তারপরও জীবন থেমে থাকেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আতাউর রহমান দীর্ঘ ৪০ বৎসর শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) উপজেলার দরগাপাশা আব্দুর রশীদ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : মো. আতাউর রহমান ২২ জানুয়ারি ১৯৫৮ খ্রি. সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) উপজেলার দরগাপাশা ইউপি’র বাগের কোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. আব্দুল জব্বার ও মাতা মোছা. আতিবা খানম। শিক্ষকের পিতার পেশা ছিল কৃষি। পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে তিনি। ছোট এক বোন বিবাহিত। মো. আতাউর রহমানের কোনো সন্তানাদি ছিল না।
শিক্ষা জীবন : মো. আতাউর রহমান নিজ গ্রাম মৌগাঁও বাগের কোনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৬২ সালে শিক্ষা জীবনের শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। ১৯৬৭ সালে স্থানীয় দরগাপাশা আব্দুর রশীদ উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনের শুরু।
উল্লেখ্য, দরগাপাশা আব্দুর রশীদ উচ্চ বিদ্যালয়টি মরহুম স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের পিতা আব্দুর রশীদ চৌধুরী সাহেবের নামে উনার নিজ গ্রাম দরগাপাশায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। যা তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলা) সুনামগঞ্জ সদর থানার বর্তমানে শান্তিগঞ্জ ( দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা) উপজেলায় অবস্থিত।
১৯৭২ সালের দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডের নিয়মিত ছাত্র হিসাবে মানবিক বিভাগে উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এসএসসি পাশ করার দীর্ঘ আঠারো বছর পর ১৯৮৯ সালে মানবিক বিভাগে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে এমসি কলেজ কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ (উচ্চ মাধ্যমিক) পাশ করেন। ১৯৯৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমসি কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে তৃতীয় শ্রেণীতে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এছাড়া ২০০৩ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএড দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।
শিক্ষকতা জীবন : ১৯৭৯ সালে জানুয়ারিতে মো. আতাউর রহমানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক দরগাপাশা ইউনিয়নের আমরিয়া গ্রাম নিবাসী জনাব আখতারুজ্জামান স্যারের পরামর্শে সদ্য প্রতিষ্ঠিত আমরিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় প্রতিষ্ঠাতা সহকারী শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতার মহান পেশায় যোগদান করেন। মার্চ/১৯৮২ খ্রি. পর্যন্ত তিনবছর ওই মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে এপ্রিল/১৯৮২ খ্রি. থেকে জুলাই ১৯৮২ খ্রি. পর্যন্ত স্থানীয় সিদখাই বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এবং আগষ্ট/১৯৮২ খ্রি. থেকে জুন/১৯৯১ খ্রি. পর্যন্ত সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার শাখারীকোনা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তৎপরবর্তীতে ১৯৯১ সালে দরগাপাশা আব্দুর রশীদ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (ইংরেজী), সিনিয়র শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় ৪০ বৎসর শিক্ষকতার পর ২২/০১/২০১৮ খ্রি. তারিখে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কথা : ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের পর হানাদার বর্বর সেনাদের গণহত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ পাশবিক নির্যাতনের খবর জনশ্রুতিতে কানে আসে। দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে যখন এ দেশের ছাত্র সমাজসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া শুরু করে তখন মো. আতাউর রহমান দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তিনি দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে একই গ্রামের ছয়জন সঙ্গীসহ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ চলার পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধাগন মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে স্ব-স্ব অবস্থানে ফিরে যান।
তিনি পাক হানাদারদের অমানবিক ও লোমহর্ষক ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন ১৯৭১ সালের ১১ ই মে তারিখে। মুক্তিযুদ্ধের সেসব স্মৃতির কথা তুলে ধরে বলেন- তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার সদর থানার জয়কলস ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামে (বর্তমানে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা সদরে অবস্থিত) স্থানীয় পাকিস্তানীদের দালাল জয়কলস ইউনিয়নের উজানীগাঁও নিবাসী কুখ্যাত রাজাকার ছত্তার মিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় দালাল রাজাকারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গণহত্যাসহ নারী নির্যাতন ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীসহ ছাত্র জনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী ভারতে যেতে শুরু করে।
আমি ও আমার সমবয়সী একই গ্রামের দুই সহযোগী (মদরিছ মিয়া ও হানিফ উল্লাহসহ) সঙ্গীয় হানিফ উল্লার পিতার ছোট একটি নৌকা নিয়ে আগষ্ট মাসের মাঝামাঝির দিকে কোন এক রাতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ছাতক থানার জাউয়াবাজার ইউনিয়নের গনিপুর গ্রামে সঙ্গীয় মদরিছ মিয়ার জনৈক আত্মীয়ের বাড়িতে রাত্রিযাপন করি। পরদিন সকালে রওয়ানা দিয়ে জাউয়াবাজার ব্রীজের নিচ দিয়ে রাজাকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তড়িঘড়ি করে উত্তরের হাওড়ে গিয়ে মোটামুটি নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাই। সারাদিন অজানা অচেনা পথে পথে ঘুরেঘুরে পথিমধ্যে পেয়ে গেলাম বড়গল্লা এলাকার অধিবাসী আমাদেরই সমবয়সী এক ছেলে নৌকা যোগে তার নানা বাড়ি থেকে মা ও ছোট্ট ভাইবোন নিয়ে নিজ বাড়িতে যাচ্ছিল। সঙ্গে পঞ্চাশোর্ধ তার নানাও রয়েছেন। আমরা তাদের সাথে ছাতকের পশ্চিমে সুরমা নদীতে গিয়ে পড়লাম। তখন প্রসঙ্গক্রমে ঐ ছেলেটির মা আমাদের গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আমার সঙ্গীর হানিফ উল্লার ফুফুত্ব ভাইয়ের বাড়ি দারগাখালি সৈদাবাদ গ্রামে যাওয়ার কথা বলি। এসময় ছেলেটির নানা আমাদের হাতের ইশারায় একটি পথ দেখিয়ে দিলে বলল ঐ পথে হাদারটিলা হয়ে সৈদাবাদ যাওয়া যাবে। আমরা তার কথামত সেই পথেই রওয়ানা হলাম। সামান্য কিছুদূর যেতে না যেতেই ঐ ছেলের মায়ের মায়াভরা কণ্ঠে শুনতে পেলাম ‘ঐদিক দিয়ে ঐ ছেলেগুলো গেলে ওরা মহাবিপদে পড়বে।’
‘তাই তোমরা ডাক দিয়ে বল- আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য।’ এই মায়াভরা কথাটি শোনার সাথে সাথে ছেলেটি আমাদেরকে হাত ইশারা করে জোরে চিৎকার দিয়ে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য ডাক দেয়। অমনি নৌকার দিক পরিবর্তন করে ছুটে গেলাম তাদের কাছে। তখন আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসতে শুরু করল। অন্ধকার ঘনিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমরা তাদেরকে খুব কাছ থেকে অনুসর করতে লাগলাম। আনুমানিক রাত আট ঘটিকায় আমরা পৌঁছে গেলাম ছাতক শহরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সেই বড়গল্লা টিলায়। রাতের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা তাদের বাড়িতেই হল। পরদিন সকাল বেলা সে ছেলেটির বাবা আমাদের কাছে তার পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি সেখানকার সংগ্রাম কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য। তিনি আমাদেরকে পরের দিন নিজ বাড়িতে থাকার অনুরোধ করে বললেন, আগামী রাত শবে-বরাত উপলক্ষে মিলাদ পড়ানো হবে। তাউ উক্ত মিলাদে অংশ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। আমার সঙ্গীরাসহ তার এমন আন্তরিকতাপূর্ণ অনুরোধে স্বাচ্ছন্দে মেনে নিলেন। এর পরের দিন তিনি আমাদেরকে অন্য একজন সংগ্রাম কমিটির সদস্যের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নিকট। সেখানে যেয়ে দেখলাম- আমাদের মত আরও ১০/১২ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। কমান্ডার সাহেবের নিয়োজিত একজন মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে আমাদের ১৪/১৫ জনের দল নিয়ে যাওয়া হল চেলার নিকটবর্তী ডিংরাই মুক্তিযোদ্ধা ইউথ ক্যাম্পে। উক্ত ইউথ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন কমরেড মানিক মিয়া। তিনি আমাদের পাগলা ইউনিয়নের দামধোরতপী গ্রামের বাসিন্দা। ক্যাম্পে অবস্থানের ২/৩ দিনের মধ্যেই জেনে গেলাম তিনি আমার অত্যন্ত নিকট আত্মীয় আপনজন। আমার বিস্তারিত পরিচয় দেওয়ার পর তিনিও আমাকে চিনতে পারেন। আমার আত্মীয়তার সুবাদে মানিক ভাইয়ের সাহায্য ও সহযোগিতায় মাত্র ১৪ দিন ইউথ ক্যাম্পে অবস্থানের পরই আমাদের সহ মোট ৩০৮ জনকে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ই.কো. ওয়ান নামক ট্রেনিং সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দিনের প্রথমার্ধে ইন্ডিয়ার ট্রান্সপোর্ট গাড়ী দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে প্রথমে নজরে পড়ল আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার সবুজ শ্যামল গ্রামগুলো। বর্ষাকালে গ্রামগুলোর চারধারে পানি যেন গ্রামগুলো পানিতে থৈ থৈ করে ভেসে আছে। আর এগুলোকে দেখা যাচ্ছে যেন বোরো জমির সীমানা আইলের মত। দিন শেষে অপরাহ্নে চোখে পড়ল খাসিয়া পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টি বহুল শহর চেরাপুঞ্জি ও জুয়াই শহর। রাতের খাবারের জন্য এখান থেকে প্রয়োজনমত পাউরুটি, বনরুটি ও কলা কিনে নিলাম। শুরু হল আবার যাত্রা। সারারাত পাহাড়ি পথে গাড়ী চলতে চলতে সুবেহ সাদিকের সময় এসে পৌঁছাল ডাউকি নামক স্থানে ভোর হতেই চোখে পড়ল বাংলাদেশের তামাবিল বাজার। ডাউকিতে নাস্তা সেরে আমাদের কাফেলা পাহাড়ী রাস্তা ধরে ১০/১২ ঘন্টা হেঁটে পৌঁছলাম কাংখিত ই.কো. ওয়ান নামক ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে ২১ দিন অস্ত্র প্রশিক্ষণ (রাইফেল-এসএলআর,এলএমজি স্ট্যান্ডগান/এসএমজি গ্রেনেডসহ মাইন বিস্ফোরণ) শেষে আমাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন সাব সেক্টরগুলোতে। আমি ও আমার সঙ্গীদের পাঠানো হল ০৫নং সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকত আলীর অধীনস্থ সেক্টরের চেলা সাব সেক্টরে। চেলা সাব সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিন। প্রশিক্ষণ শেষে ফিরতি পথে চোখে পড়েছে মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী মনোমুগ্ধকর শিলং শহর। রাত শেষে আমাদেরকে চেলার অদূরে পাথরঘাট নামক স্থানে নামানো হয়। এর মাত্র একদিন পর চেলা সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার বাঁশতলায় আমাদেরকে নিয়ে আসা হয়। বাঁশতলায় অবস্থানকালীন সময়ে ঈদুল ফিতর উদ্যাপন আমার নিকট স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর ২/১ দিনের মধ্যে আমাদের সঙ্গীয় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে পাঠিয়ে দেওয়া হল হরিনা পার্টি বাজারের উত্তরে অবস্থিত ভারতীয় সীমান্তবর্তী রনভূঁই নামক গ্রামে অবস্থানরত ‘জি, কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার খুর্শিদ আলম সাহেবের কোম্পানীতে। আমাদের কোম্পানী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পর্যায়ক্রমে টেংরাটিলা, বড়গল্লা টিলা, লম্বা টিলা প্রভৃতি স্থানে সম্মুখ সমরে অংশ নেয়। মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে হানাদার বাহিনী যখন পিছু হটে ছাতক শহরে অবস্থান নেয়-ঠিক সেই সময়ে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ভোররাতে আমাদের কোম্পানী অবস্থান নিল ছাতক শহরের সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে সিমেন্ট ফ্যাক্টরী এলাকায়। সারাদিন অবিশ্রান্ত গোলাগুলির পর দিন শেষে রাত অনুমান একটার সময়ে কোম্পানী কমান্ডারের নির্দেশে ঘাটে বাধা ফেরী নৌকা করে ১৫/১৬ জনের একটি অগ্রবর্তী দলকে নিয়ে তাঁতীকোনা নামকস্থানে এসে পৌঁছে। এই অগ্রবর্তী দলে আমি ও আমার সঙ্গী হানিফ উল্লাহও ছিলাম। এটাই আমার জীবনে ছাতক শহরে প্রথম পদার্পন। সেখান থেকে গাইডের মাধ্যমে অগ্রবর্তী মুক্তিযোদ্ধা দলটি অতি সন্তর্পনে সতর্কতার সাথে এক পা দু’পা করে হেঁটে হেঁটে পৌঁছলাম তখনকার সময়ের ছাতক বাস স্ট্যান্ডে। পাশেই দেখা গেল ছাতক হাইস্কুল ও সিনেমা হল। ছাতক শহরে পৌঁছে দেখা গেল পাক বাহিনী গোবিন্দগঞ্জের দিকে পালিয়ে গেছে। তখন কমান্ডার সাহেব ওয়্যারলেস বার্তার মাধ্যমে নদীর ওপারে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ছাতক শহরে আসার নির্দেশ দিলে কোম্পানীর অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা নদী পার হয়ে ছাতক শহরে এসে জমায়েত হয়। এসময় মূহুর্মূহু জয়বাংলা শ্লোগানে ছাতক শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠে। বিজয়ের একি আনন্দ নিজ চোখে না দেখলে বুঝা বা অনুমান করা খুবই মুশকিল। ০৬ ডিসেম্বর/১৯৭১ ইং তারিখে শিল্প শহর হানাদার মুক্তি হয়। ছাতক বাগবাড়ী এলাকার জনৈক হাজী ময়না মিয়ার বাসায় আমাদের কোম্পানী ৩/৪ দিন অবস্থান করার পর ০৯ ডিসেম্বর ভোররাতে গোবিন্দগঞ্জ রেল স্টেশনের দক্ষিণে অবস্থিত রাধানগর গ্রামে আমাদের কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয়। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গোবিন্দগঞ্জ আফজালাবাদ রেল স্টেশনে অবস্থানরত পাক বাহিনী আমাদেরকে লক্ষ্য করে তীব্র আক্রমণ চালায়। পাক বাহিনীর মরনপন আক্রমণে ঠিকে থাকতে না পেরে আমরা ধীর পদে পিছু হটে হটে রাধানগর গ্রামের দক্ষিণে গোপালনগর গ্রামে চলে আসি। পাক সেনারা আর সামনে এগুতে সাহস না পেয়ে আফজালাবাদ রেল স্টেশনে ফিরে যায়। বানারসী গ্রামে ২/৩ দিন অবস্থানের পর আমাদের কোম্পানী ১৩ ডিসেম্বর/১৯৭১ ইং তারিখে বিশ^নাথ থানার খাজাঞ্চীগাঁও ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামে অবস্থান নেয়। স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে খবর পেয়ে সৎপর মাদ্রাসায় অবস্থানরত পাক বাহিনী ও রাজাকারের একটি দল আমাদের অবস্থানের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। তাদের সামনে ঠিকে থাকতে না পেরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে রায়পুর গ্রামের দক্ষিণে অবস্থিত মাখরগাঁও গ্রামে চলে আসি। পাক বাহিনী বেপরোয়াভাবে আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে লাগোয়া পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি একটি বিল সাঁতরিয়ে বিলের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নেই। পাক বাহিনী তেমন সুবিধা করতে না পেরে অপরাহ্নের দিকে পুনরায় সৎপুর চলে যা এবং সেখান থেকে পরদিন লামাকাজি হয়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়। এই সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের সহযোদ্ধা আব্দুল হামিদ এবং মতিলাল শহীদ হোন। পরদিন ১৪ ডিসেম্বর/১৯৭১ ইং তারিখে উল্লেখিত বিলের পূর্ব পাড়েই তাদেরকে সমাহিত করা হয়। রাত শেষে আমাদের কোম্পানী আমতৈল গ্রামে অবস্থান নেয়।
সেখানে ২ দিন অবস্থানের পর দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পেয়ে আমাদের সহযোদ্ধারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ‘জয়বালা’ শ্লোগান দিয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেন। আমতৈল গ্রামে ৩/৪ দিন অবস্থানের পর আমাদের কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বনাথ আলিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান নেয়। এসময় কোম্পানী কমান্ডার সাহেবের নির্দেশে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশ্বনাথের রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আমাদেরকে পুনরায় ছাতক ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ছাতক থেকে আমাদের সহযোদ্ধা অনেককে সুনামগঞ্জ পিটিআই স্কুলে পাঠানো হয়। এখানে কিছুদিন থাকার পর আমাদেরকে কর্ণেল আতাউল গনী ওসমানীর স্বাক্ষর যুক্ত মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট প্রদান করে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলে, সে বছর অনুষ্ঠিতব্য ঈদুল আযহার ৫/৬ দিন পূর্বে নিজ বাড়িতে চলে আসি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যেহেতু আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। সেই হিসেবে ১৯৭২ সালের ২য় পর্বে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হই। এসএসসি পাশ করার পর আর্থিক অনটনের কারণে কলেজে ভর্তি হতে না পেরে বাবার সাথে কৃষি কাজ শুরু করি।
প্রশিক্ষণ : তিনি আব্দুর রশীদ উচ্চ বিদ্যালয়ে পরবর্তীতে সহকারী শিক্ষক (ইংরেজী) হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ায় উক্ত বিষয়ের উপর বেশ কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে রাজধানীর ঢাকার BIAM ফাউন্ডেশনে দীর্ঘ এক মাসব্যাপী ‘Communicative English’ এর প্রশিক্ষণ নেন। পার্বত্য জেলাগুলো ছাড়া সমগ্র দেশের অপর ৫২টি জেলা থেকে একজন করে মোট ৫২ জন ইংরেজী শিক্ষকের বাস্তবধর্মী প্রশিক্ষণ শিক্ষকের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এছাড়া তিনি ২০০৮ সালে দুদিন ব্যাপী শ্রেণীকক্ষে এইচআইভি এবং এইডস বিষয় পাঠদান কোর ট্রেইনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বাস্তবায়নে ছিল পায়াকট বাংলাদেশ।
উপজেলা কমান্ডার নির্বাচিত : ‘একমুক্তি এক ভোট’ প্রক্রিয়ায় ২০১০ সালে যখন সারা দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন নব্য প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শ্রদ্ধাভজন বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় মো. আতাউর রহমানকে উপজেলা কমান্ডার নির্বাচিত করেন। তিনি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার পর থেকে অদ্যাবধি নির্বাচিত কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কমান্ডার থাকাকালীন সময়ে স্থানীয় সুহৃদ ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় দরগাপাশা ইউনিয়নের বাগেরকোনো টুকেরবাজারে ১৯৮৯ সালে ‘ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদদ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে একটি মুক্তিযুদ্ধ লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার কৃতি সন্তান পরিকল্পনামন্ত্রী জনাব আলহাজ্ব এম এ মান্নান মহোদয়ের প্রচেষ্টায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জে দৃষ্টিনন্দন মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করে জাতির শ্রেষ্ট সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধাদের দৈনন্দিন অফিস কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শান্তিগঞ্জ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
সুনামগঞ্জ জেলার ১১ উপজেলার ২২ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ২২ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আতাউর রহমান কৈশোর ও যৌবনের মূল্যবান সময়ে মাতা, মাতৃভূমি ও শিক্ষিত সমাজ বিনির্মানে নিজের শক্তি, সামর্থ, শ্রম ও মেধাকে নি:সংকোচে উৎসর্গ করেন। তিনি শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি সমাজ সংস্কার, অশিক্ষার প্রভাব দূরীকরণ, জনসচেতনতা কল্যাণমুখী কাজ করে গেছেন। বর্তমানে অবসর জীবনযাপনের মধ্যদিয়ে জাতির শ্রেষ্ট সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাথে সম্পৃক্ত আছেন। জীবনের শেষ সময়টুকু এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে জাতির শ্রেষ্ট সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার আন্তরিত প্রত্যাশা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তিনি। আমরা এই বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আতাউর রহমানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি ।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১,৬০০ বার