শামীমুল হক-

রাজধানীর প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালেই রয়েছে ভিক্ষুকের ভিড়। সিগন্যালে গাড়ি থামলেই তারা হাত বাড়িয়ে দেয়। নানা আকুতি জানায় ভিক্ষার জন্য। কিন্তু ক’বছর  ধরে নতুন আইডিয়া নিয়ে মাঠে নামে কিছু মানুষ। গাড়িতে উঠেই যাত্রীদের হাতে ধরিয়ে দেয় একটি আবেদনের ছোট্ট কাগজ। যাতে লেখা থাকে তার সমস্যার কথা।তাকে সাহায্যের আবেদন। এভাবে চলে কিছু দিন। আবার নতুন করে দেখা দেয় আরেক পন্থা। এবার ছোট কাগজে কম্পোজ করা সমস্যার কথা জানান দেয়ার পাশাপাশি অনুরোধ থাকে তার কাছ থেকে দুটি চকলেট কিনে সহযোগিতা করার। প্রথম প্রথম মানুষ সহযোগিতাও করেছে। একপর্যায়ে তা অনেকটা কমে আসে। গতকাল জিরো পয়েন্ট সিগন্যাল থেকে বেলা ১২টায় একটি গাড়িতে উঠেন এক গৃহবধূ। তার কোলে ছোট্ট একটি শিশু। যথারীতি সবার হাতে ধরিয়ে দেন কম্পোজ করা কাগজ। যাতে লেখা সম্মানিত যাত্রী, ভাই ও বোনেরা। আমার স্বামীর কিডনি নষ্ট। আমার দুটি সন্তান আছে। আপনারা যদি আর্থিক সাহায্য করেন তাহলে আমার স্বামী ও সন্তান বেঁচে যাবে। দয়া করে দুটি টাকা দিয়ে আমার স্বামী ও সন্তানকে বাঁচান। তার এ আকুতিতে কেউ সাহায্য করেছে, কেউবা ফিরেও তাকায়নি। প্রেস ক্লাবের সামনে এসে গাড়ি থেকে তিনি নেমে যান। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে কেন মানুষের কাছে হাত বাড়াচ্ছেন। আপনি তো ইচ্ছে করলে পাড়া-মহল্লায় বাড়ি বাড়ি কাজ করলেও ভালো টাকা আয় করতে পারেন। তিনি বলেন, সব করে এসেছি। বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে যে টাকা পাই, তা দিয়ে কিছুই হয় না। স্বামীর ওষুধ, পথ্য। তারপর ঘরভাড়া। সন্তানদের নানা খরচ মিলিয়ে আর পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে এভাবে মানুষের কাছে হাত পাতছি। আপনি জানেন, সকালে পানি দিয়ে ভিজিয়ে একটি আটার রুটি খেয়ে বেরিয়েছি। আবার সন্ধ্যায় গিয়ে রান্না করে তারপর খাবো। স্বামী রহমত আগে রিকশা চালাতেন। এখন কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। তার ওষুধ খরচ এখান থেকেই মিটাই। কী করব বলুন? নিজের ভাই আছে। স্বামীর ভাইও আছে। তাদেরও তো একই অবস্থা। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মাঝে মাঝে জীবনটাকে দোজখ মনে হয়। এ থেকে মরে গেলে ভালো ছিল। তার কথা- এখন মানুষ সন্দেহের চোখে দেখে। নিজেও লাজ-শরম বাদ দিয়ে পথে নেমেছি। দিন শেষে যত টাকা পাই, তা দিয়ে চালিয়ে নিই। আগে যে সবজি ২০ টাকায় কিনতাম। এখন তা কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকায়। চাল-ডালের দামও নাগালের বাইরে। দিন দিন কঠিন হচ্ছে চলা। কেন যে গরিব ঘরে জন্ম হলো আমার। শাহবাগ মোড়ে এক গাড়িতে উঠেন ষাটোর্ধ্ব এক লোক। শরীর নিয়ে চলতে পারছিলেন না। কথা বলছেন আস্তে আস্তে। তার হাতে শ্বাসকষ্টে গ্যাস দেয়ার একটি যন্ত্র। আস্তে আস্তে বলছেন, আমি শ্বাসকষ্টের রোগী। আমার গ্যাস দিতে হয়। এর দাম ১৬৫ টাকা। দয়া করে যদি আপনারা আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে আমি ওষুধটি কিনতে পারি। প্রায় প্রতি রাতেই কাওরানবাজার মোড় থেকে দুই শিশু গাড়িতে উঠে হাতে কম্পোজ করা সাহায্যের আবেদনের কাগজ নিয়ে। যাত্রীদের কারো হাতে, কারো উরুতে ছিটিয়ে দিচ্ছে। শুরু থেকে সাহায্যের এ আবেদন ছিটিয়ে দিয়ে যায়। আবার শেষ দিক থেকে কাগজগুলো চেয়ে নেয়। এ সময় কারো দয়া হলে কিছু দেয়। তবে বেশিরভাগ যাত্রীই কাগজ ফিরিয়ে দেয়। গুলিস্থান মোড়ে এক লোক প্রায়ই গাড়িতে ওঠেন। তিনি ইংরেজিতে অনর্গল বলে যান, আমার তিন মেয়ে। আমি আগে ভালো চাকরি করতাম। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এখন আর চাকরি করতে পারছি না। তিন সন্তানের লেখাপড়া ও সংসার খরচ চালাতে আপনাদের দরবারে হাজির হয়েছি। আমি কখনো এ পথে নামতাম না। বাধ্য হয়ে নেমেছি। আপনারা যদি সহযোগিতা করেন তাহলে এ অর্থ দিয়ে বাজার কিনে এখন বাসায় নিয়ে যাবো। তারপর রান্না হবে। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবো। এমন শত শত নারী-পুরুষ রাজধানীর রাজপথে হাত পাতছে মানুষের কাছে। ফার্মগেট এলাকা থেকে বোরকা পরা এক মহিলা বিহঙ্গ গাড়িতে উঠে কেঁদে ফেলেন। বাবারে আমার হাতে টাকা নেই। সারা দিন কিছু খাইনি। আপনারা কিছু দিলে আমি খাবো। দয়া করে কিছু দিন। শাহবাগ মোড়ে প্রায়ই দেখা যায়, এক লোক গাড়িতে উঠে তার লুঙ্গি উরু পর্যন্ত তুলে যাত্রীদের দেখায়। বলে, আমি রিকশা চালাতাম। এক এক্সিডেন্টে আমার পা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এখন চিকিৎসা করাতে পারছি না। আপনারা যদি কিছু সাহায্য দেন তাহলে চিকিৎসা খরচ চালাতে পারবো। এমন আরেকজনকে দেখা যায়, যার একটি হাত নেই। তিনি গাড়িতে উঠেই হাতটি দেখান সবাইকে। বলেন, আমি ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলাম। একদিন বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে হাত পুড়ে যায়। হাতটি কেটে ফেলতে হয়। এখন কিছু করতে পারি না। আপনাদের দরবারে তাই এসেছি। আপনারা যদি কিছু দেন তাহলে আমি সংসার চালাতে পারবো। এমন অসংখ্য চিত্র রাজধানীতে। এদের একজন রহমত উল্লাহ। তিনি বলেন, জানেন অভাবী সংসারে বড় হয়েছি। জীবনে অনেক স্বপ্ন নিয়ে লেখাপড়া করছিলাম। ক্লাস টেনে পড়ি। একদিন বাবা মারা যায়। আমার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ছোট ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে কী করব? ঘরে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছিলাম। একদিন পটুয়াখালীর গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় রওনা দিই। এলাকার একজনের সহযোগিতায় একটি ডাইং কারখানায় চাকরি নিই। অনেক কষ্টের কাজ। সেখানে একটি দুর্ঘটনায় আমার হাত ভেঙে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা করাই। এরপর একদিন ডান হাতটি কেটে ফেলতে হয়। কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সুস্থ হয়ে ঠিকানা হয় বাসস্ট্যান্ড। রাতে ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকি। একদিন বাসে উঠে করুন কাহিনী মানুষের কাছে তুলে ধরি। কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু এখন মানুষ এসব আর বিশ্বাস করেন না। কেউ কেউ কটাক্ষ করে কথা বলেন। সন্দেহের চোখে দেখেন। আচ্ছা বলুন, কেউ কি শখে মানুষের কাছে হাত বাড়ায়? আসলে নিরুপায় হয়েই এ কাজ করে। অন্য কোনো রাস্তা থাকলে এ পথে নামতাম না। তার পরও বলি, যদি চলার কোনো পথ পাই তাহলে এ রাস্তা ছেড়ে দেবো। তিনি বলেন, যে টাকা পাই তা দিয়ে নিজে চলি। বাড়িতে পাঠাই। কারণ আমার ওপর পুরো সংসারের ভার। জানিনা এমন কেন হলো? এ থেকে পরিত্রাণের পথও আমার জানা নেই। শুধু বলবো, আমার মতো পরিস্থিতি যেন আর কারো না হয়। তবে কেউ কেউ যে প্রতারণা করেন না এমনটা নয়। তামান্না নামে প্রাইভেট ফার্মে কর্মরত একজন জানান, তিনি প্রতিদিনই শাহবাগ দিয়ে তার অফিসে যাতায়াত করেন। তার গাড়িটি শাহবাগ পৌঁছলেই টুপি-দাঁড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক এসে বলতেন, আমার মেয়ের বিয়ে। সত্যি বলছি, আমি ভিক্ষুক নই। ভদ্র মানুষ। কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা। আমাকে সহায়তা করুন। তার এ কথা শুনে মায়া হয়। কিছু টাকা দেই। এভাবে দুই-তিন দিন টাকা দেই তাকে। হঠাৎ একদিন তার সঙ্গে দেখা হয় পল্টন মোড়ে। সেখানেও একই ভঙ্গিতে টাকা চান। তাকে শাহবাগ মোড়ের কথা মনে করিয়ে দিলে দ্রুত সামনে থেকে চলে যান। এমন অনেকে আছেন মিথ্যে বলে মানুষের মনে নাড়া দেয়ার চেষ্টা করেন। মানুষ সাড়াও দেন। কিন্তু যখন দেখেন বার বার একই কথা বলছেন তখন তাদের মনে সন্দেহ দেখা দেয়।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn