সিলেটী হোসনার শোকে আর বিয়ে করেননি হবু বর
মুনজের আহমদ চৌধুরী :: হোসনার হবু সে বরটি আজো বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি। বিয়ের দেড় মাস আগেই হবু স্ত্রীকে হারিয়ে এখনো শোকাচ্ছন্ন লেষ্টারের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সে তরুনটি। হোসনার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মৌজুস (কুইসাউড়া) গ্রামে। হোসনাদের চলে যাবার প্রথম বার্ষিকীকে সামনে রেখে যোগাযোগ করা হলেও, কথা বলতে রাজি হননি তিনি। তিনি চান, হোসনাকে ঘিরে তার ব্যাক্তিগত অনূভূতি ব্যাক্তিগতই থাক। শুধু হবু বর নয়, হোসনার চলে যাওয়া এভাবেই থমকে দিয়েছে বহু স্বজন-প্রিয়জনের জীবন। তারা জানেন, হোসনার আর কখনো ফেরা হবে না। ফেরা হবে না ভাইয়ের কাছে, হবু স্বামীর কাছে, বন্ধুদের আড্ডায়। গ্রিনফেল টাওয়ারের আগুন ভবনটির অন্য বাসিন্দাদের মতো হোসনার জীবন আর সপ্নের মাঝখানে তুলে দিয়েছে মৃত্যুর দেয়াল। দেয়ালের এ পারে চিরঘুমের ঠিকানায় থাকা হোসনার জন্য এখনো অশ্রুসজল হন স্বজনেরা। বন্ধুরা তার চলে যাবার দিনটি স্মরণ করবেন মোমবাতির প্রজ্জলনে। লন্ডনের লাটিমার রোডের গ্রেনফল টাওয়ার বিভীষিকার আগুনে জ্বলে এখন যেন শোকের দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবিম্ব। ১৪ জুন ছিল ভয়াল অগ্নিকান্ডের প্রথম বছরপূর্তি। এ ভবনের ১৭ তলার ১৪৪ নাম্বার ফ্লাটে মা বাবা আর ভাইদের সাথে থাকতেন হোসনা বেগম। তার হাইস্কুলের সহপাঠী মারিয়াম জিয়োডিভা সম্প্রতি আলাপকালে বলেছেন, সদাহাস্যময়ী হোসনার ম্মৃতি কখনো ভূলবার নয়। হোসনাদের এডমন্টনের বাড়ীতেও বহুবার গেছেন তিনি।
স্বজনরা জানিয়েছেন, ২২ বয়স বয়সী হোসনার লন্ডনে জন্ম আর বেড়ে উঠা। মায়ের সাথে দেশে গেছেন দুবার। সহপাঠীরা জানিয়েছেন এডমন্টনের ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে নিয়মিতই যোগাযোগ ছিল হোসনার। ডাক নাম তানিমা হলেও বন্ধুরা জানতেন তাকে, হোসনা নামেই। স্কুল শেষে হোসনাদের এডমন্টনের বাড়ীর দ্বার সব সময় উন্মুক্ত ছিল বন্ধুদের জন্য। হোসনার বহুবার গেছেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী বন্ধু ক্যাথি। সে সুবাদে হোসনার মা রাজিয়া বেগম আর ভাইদেরও চিনতেন। বন্ধুদের বর্ননার চোখ দিয়ে জানা হয়, প্রানোচ্ছ্বল আর শান্ত মায়াবী এক কিশোরীকে। যে হাইস্কুলে থাকতেই হিজাব পরত। ধর্মভীরু হোসনা নামাজ পড়তেন নিয়মিত। নিরহংকারী আর সহজ কথার,সরল হাসির হোসনা আর কখনো থাকবেন না বন্ধুদের আড্ডায়,এটি মনে করে অশ্রুসিক্ত তার স্কুলের সহপাঠীরা। বন্ধুরা জানিয়েছেন, কারফোন ওয়ারহাউজ নামের ফোন কোম্পানিতে কাজ করতেন হোসনা। বন্ধুরা নতুন ফোন কিনতে গেলেও ষ্টাফ ডিসকাউন্ট পাইয়ে দিতেন হোসনা। কখনো নিজের ডিসকাউন্ট লিমিট শেষ হলে অন্য সহকর্মীদের সাহায্য নিতেন। পরিবার আর ঘরমুখী হোসনার ঘরে ফিরতে দেরী হলে মা আর বাবা অস্থির থাকতেন ফোনের ঐ প্রান্তে। বন্ধুদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে কথা নিয়মিত ছিল তার সরব উপস্থিতি। ফেসবুকে নিজের সেলফি আপলোড করে শো-অফ করতে পছন্দ না হোসনা। নিজের ছবি তুলতে ভালবাসলেও সেগুলো পোষ্ট করতেন না সামাজিক মিডিয়ায়। মেধাবী,বিনয়ী আর অনুভূতিপ্রবন হোসনার আকস্মিক করুণ চলে যাওয়া যেন ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে দিয়েছে বন্ধু,স্বজনদের জীবন। নিষ্ঠুর নিয়তির আগুন কেড়ে নিয়েছে সহসাই সব। মৃত্যু নিঃস্বীম দেয়াল তুলে দিয়েছে হোসনা আর তাকে ঘিরে স্বজনদের থাকা সব সুখ-স্মৃতির মাঝখানে। বিয়ে ঠিক হবার খবর হোসনা আগেভাগেই বলে রেখেছিলেন বন্ধুদের। যাতে, সবাই ছুটি নিয়ে তার বিয়ের অনুষ্টানে যোগ দিতে পারে। ঠিক করা হয়েছিল বিয়ের ড্রেস কোডও। পরিবারের পছন্দের লেষ্টারের সুদর্শন পাত্রটিকে তার নিজেরও যে খুব পছন্দ,তাও লাজুক হাসিতে বান্ধবীদের জানিয়ে ছিলেন হোসনা। বর-কনে দুজনে মিলেই পছন্দ করেছিলেন বিয়ের কেনাকাটা। সব আয়োজন ছিল প্রায় সমাপ্ত। গত ২৯ জুলাই লন্ডনের বালহামের মেমন সেন্টারে বিয়ের অনুষ্টানস্থল ঠিক করেছিল দুই পরিবার। আগুনের নির্মমতা বিয়ের পিড়িতে আর বসবার ফুসরৎ দেয়নি হোসনাকে। সংসারের সপ্নের আর পাওয়া হয়নি পরিনতি। আগুন যখন গ্রাস করছিল হোসনাদের ফ্লাটটিকে,তখন হবু বরের সাথে শেষ কথা হয় হোসনার। সেহরীর পর হোসনার ফোনে আগুন লাগার খবরটি পান হবু বর রহমান। হোসনার সাথে কথা বলতে বলতেই ৯৮ মাইল পথ পেরুতে ঝড়ের বেগে ছুটতে থাকে গাড়ি। গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ঠিকই অশ্রুসজল নয়নে হোসনাদের ভবনটির নিচে এসে পৌছেছিলেন তিনি। কিন্তু,ততক্ষনে সব শেষ। লন্ডনের ভোরের আকাশ যেন তখন কাঁদছিল,লেলিহান শিখার ধুমায়িত অন্ধকারে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া হোসনার ফোনে এরপর আর কোন কল যায়নি।
সংসার সাজাবার অপেক্ষায় হবু বরের সাথে আবেগ,খুনসুটি আর ভালবাসাময় সোনালী দিনগুলি কাটাচ্ছিলেন হোসনা হয়তোবা। বৈদ্যুতিক ত্রুটির আগুন হোসনাকে কেড়ে নিয়েছে ঠিকই। ভবনটির আগুনও থেমেছে। কিন্তু, সম্পর্কের পরিনতি না পাবার বেদনার আগুন হোসনার হবু বরটিকে বহুকাল পোড়াবে ভালবাসার আগুনে। পেয়েও না পাওয়ার বেদনাকে তো সান্তনার কথামালার সাধ্য নেই ভুলিয়ে দেবার। হোসনা, হোসনার মা বাবা আর দুভাই মোহাম্মদ হানিফ আর মোহাম্মদ হামিদ এখন লন্ডনের গার্ডেন অফ পীসের কবরস্থানে আছেন চীরঘুমে। হোসনার একমাত্র জীবিত ভাই লন্ডনে বসবাসরত মোহাম্মদ হাকিম জানিয়েছেন, তাদেঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। হোসনার বাবা কমরু মিয়ার ভাগ্নে লন্ডনের প্রবীন কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব ও সাংবাদিক কে এম আবু তাহির চৌধুরী বলেন, আমি হোসনার হবু বরটিকে হোসনার লাশ নামাবার সময় অঝোরে কাদঁতে দেখেছি। তিনি জানান,কমরু মিয়াদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্টান সেন্ট্রাল লন্ডনের বেঙ্গল রেষ্টুরেন্ট। প্রায় ৯০ বছর বয়সী কমরু মিয়া অবসর জীবন যাপন করছিলেন।
দেশে থাকা স্বজনরাও শোকাচ্ছন্ন :
হোসনাদের গ্রামের বাড়ী মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখাইলকুরা ইউনিয়নের খৈশাউড়া গ্রামে। আগুন লাগার পর ঘন্টাখানেক লন্ডনে অবস্থানকারী স্বজনদের সাথে টেলিফোনে পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ ছিল। রাত আড়াই-তিনটার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর পর ভবনে অবস্থানকারী মো. কমরু মিয়া (৯০), কমরু মিয়ার স্ত্রী রাবিয়া বেগম (৬৫), ছেলে আব্দুল হানিফ (২৯) ও আব্দুল হামিদ (২৬) এবং মেয়ে হাসনা বেগম তানিমা (২২) মারা যান অগ্নিদগ্ধ হয়ে। তারা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত বাচঁবার চেষ্টা করছিলেন। পরিবারের একেকজনের লাশ পাওয়া যায় একেক ফ্লোরে। কমরু মিয়ার দেশে অবস্থানকারী ছেলে মো. সুজন মিয়া এ প্রতিবেদকের সাথে ফোনে আলাপকালে জানান, ‘আমার বোন (হোসনা) আমার চাচাতো ভাই আব্দুর রহিমকে ফোন করে জানিয়েছে ভবনে আগুন লাগার কথা। খবর পেয়ে আব্দুর রহিম ভবনের নিচে ছুটে গেছে। কিন্তু ততক্ষণে আগুন ভবনে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকক্ষণ তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। তানিমা আব্দুর রহিমের সাথে বাথরুম থেকেও কথা বলেছে। আব্দুর রহিম জানিয়েছে, একপর্যায়ে তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সুজন মিয়া জানান, তাঁরা চার ভাই ও তিন বোন। এরমধ্যে তিনি ও দুই বোন দেশে। অন্যরা লন্ডনে ছিলেন।