ছামির মাহমুদ: সিলেটে কোনোভাবেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। উল্টো প্রতিদিন রেকর্ড সংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। একইভাবে করোনায় গত এক সপ্তাহ ধরে ৫ জনের বেশি মানুষ প্রতিদিন করোনায় মারা যাচ্ছেন। গত ১০ দিন ধরে প্রতিদিন সিলেটের চারটি আরটি-পিসিআর ল্যাবে গড়ে ২০০ করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। হাসপাতালেও রোগী ভর্তির জন্য শয্যা খালি নেই। সিলেটে করোনা ডেডিকেটেড ১০০ শয্যার ‘শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে’ কোনো শয্যা ফাঁকা নেই।চিকিৎসার মান ও সেবা ভালো হওয়ায় রোগীর অবস্থা খারাপ হলেই স্বজনরা রোগী নিয়ে ছুটে আসছেন শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে। কিন্তু আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় রোগীরা ফিরে যাচ্ছেন। তাছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা রোগীদেরই ওয়ার্ড ও কেবিনে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এখানে সাধারণ শয্যাও খালি নেই রোগী ভর্তির জন্য।
করোনার কোনো রোগীই এখন আর ভর্তি নেয়া যাচ্ছে না। এছাড়া গুরুতর রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আইসিইউর জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। রোগীর স্বজনরা ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। চিকিৎসকরাও নিরূপায়। কোথাও আইসিইউ শয্যা খালি নেই।সিলেট বিভাগে করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড সরকারি-বেসরকারি মোট ৮৯টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে বিভাগের চার জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ২৬টি।
সরকারি আইসিইউ শয্যা সবচেয়ে বেশি রয়েছে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল ও করোনা আইসোলেশন সেন্টারে ১৬টি। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচটি ও মৌলভীবাজার সদর আধুনিক হাসপাতালে পাঁচটি।সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর ব্যবস্থা নেই। এমনকি হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নেই আইসিইউ সুবিধা। আর বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৬৩টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেটে ২০টি এবং আখালিয়াস্থ মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের ১২টি আইসিইউ শয্যা ছাড়াও বাকি ৩১টি শয্যা অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রয়েছে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউয়ের চার্জ অতিরিক্ত হওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির রোগীরা সরকারি হাসপাতালে বেশি আসেন।এজন্য সরকারি হাসপাতালের ২৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে কোনোটিই খালি নেই। একটি খালি হলেও অন্তত আরও ১০ জন এটি পাওয়ার জন্য সিরিয়েলে অপেক্ষমান থাকেন।গত রোববার ভোরে সুনামগঞ্জের ছাতক পৌরশহরের বাগবাড়ি থেকে গণমাধ্যমকর্মী শাহ আক্তারুজ্জামান করোনার উপসর্গ ও তীব্র শ্বাসকষ্ট, জ্বর নিয়ে তার মা সুফিয়া খাতুন চৌধুরী (৬৯) কে মুমূর্ষু অবস্থায় সিলেটের বেসরকারি হাসপাতাল উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। তার আইসিইউ প্রয়োজন। তবে সেখানে কোনো শয্যা খালি না থাকায় তাকে সেখানে ভর্তি করতে পারেননি তিনি।
এরপর তিনি নগরের আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েও তার মাকে ভর্তি করতে না পেরে তিনি বাধ্য হয়ে তিনি শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল করোনা আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে যান।করোনার উপসর্গে নিয়ে যাওয়া রোগী নিয়ে যাওয়ায় চিকিৎসকরা প্রথমে জানান, করোনা রোগী ছাড়া কাউকে ভর্তি করা হচ্ছে না। তাই তারা সুফিয়া খাতুন চৌধুরীকে ভর্তি করতে পারবেন না। পরে বিশেষ অনুরোধে ভর্তি করা হলেও আইসিইউ শয্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় ৩০ ঘণ্টা অপেক্ষার পর নানা তয়তদবীর করে একটি আইসিইউ শয্যা তিনি পেয়েছেন।
একটি আইসিইউ শয্যার জন্য এমন চেষ্টার কথা জানিয়ে সমকালের ছাতক উপজেলা প্রতিনিধি শাহ আক্তারুজ্জামান বলেন, রোগী নিয়ে না আসলে বুঝতাম না। করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যার যে কতটা প্রয়োজন। রোগীর জন্য আইসিইউ সাপোর্ট দরকার এমন একাধিক রোগী নানাভাবে চেষ্টা করেও আইসিইউ শয্যা পাচ্ছেন না। শয্যা খালি না থাকায় চিকিৎসকরাও অপারগ। আইসিইউ’র জন্য মানুষের হাহাকার দেখলে চোখে পানি এসে যায়।এ বিষয়ে সিলেট জেলার সিভিল সার্জন ডা. প্রেমান্দ মন্ডল জানান, সিলেট জেলা করোনা রোগীর জন্য ডেলিগেটেড সরকারি হাসপাতাল আছে তিনটি। শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল ছাড়াও সদর উপজেলার খাদিমপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এই তিন হাসপাতালে মোট শয্যা ১৬২টি বলে জানান তিনি।
এছাড়া করোনা রোগীদের জন্য জেলা সদর ও উপজেলাগুলোর সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক মিলিয়ে সর্বমোট ৮৯১টি আইসোলেশন শয্যা রয়েছে। তবে আইসিইউ শয্যা খুবই কম।ডা. প্রেমান্দ মন্ডল বলেন, শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ১০০টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। তবে এই হাসপাতালে প্রায় সব শয্যায়ই রোগী আছেন। খাদিমপাড়ায় ৩১টি ও দক্ষিণ সুরমা ৩১টি করোনা রোগীর শয্যা থাকলেও কোনো আইসিইউ সুবিধা নেই। ফলে ওখানে খারাপ অবস্থার রোগী ভর্তি করা হয় না। তারা শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে চলে আসায় এখানে চাপ বেড়েছে।
শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সুশান্ত কুমার জানান, পুরো হাসপাতালই রোগীতে পরিপূর্ণ। কোনো রোগী মোটামুটি সুস্থ হলেই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর যে শয্যা খালি হচ্ছে সেখানে নতুন রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। আইসিইউতে শয্যা সংকট থাকায় করোনা পজিটিভ রোগী ছাড়া অন্য রোগীদের ভর্তি করা যাচ্ছে না। তবে করোনা পজিটিভ রোগীদের যথাসম্ভব রাখার চেষ্টা করছি।
সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. শামস উদ্দিন জানান, সুনামগঞ্জে করোনা রোগীদের জন্য ১৪৫টি আইসোলেশন শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে জেলা সদরে ১শটি বাকিগুলো বিভিন্ন উপজেলায়। তবে এখানে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থাও নেই।
আর হবিগঞ্জের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোখলেছুর রহমান উজ্জ্বল জানান, তার জেলায়ও কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। তবে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা রয়েছে। করোনা রোগীদের জন্য জেলা সদরে ১০০ এবং সাতটি উপজেলায় পাঁচটি করে আইসোলেশন শয্যা রয়েছে।বিভাগের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন জানান, জেলা সদরে করোনা রোগীদের জন্য পাঁচটি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে চারটিতে রোগী আছে, পুরো জেলায় ১৩০টি আইসোলেশন শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে জেলা সদরে মাত্র ৫০টি, বাকিগুলো উপজেলাগুলোয়।
সিলেট নগরের দুটি বেসরকারি হাসপাতালেও চলছে করোনা রোগীদের চিকিৎসা। তবে স্বল্প আয়ের মানুষেরা সরকারি হাসপাতালকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কারণ, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় নিম্ন আয়ের মানুষের সাধ্যের বাইরে। নগরীর আখালিয়ার মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য রয়েছে আটটি আইসিইউ শয্যা।এর মধ্যে শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত কোনো শয্যা খালি নেই বলে জানান হাসপাতালের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট রাশেদুল ইসলাম। আর দক্ষিণ সুরমার নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে ২০টি আইসিইউ শয্যা।
হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চাপ বাড়ছে। তাই আমরাও আইসোলেশন শয্যা ও আইসিইউ বেডের সংখ্যাও বাড়িয়েছি। আমাদের ২০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। একটিও খালি নেই।
এদিকে, সিলেট বিভাগে প্রতিদিনই করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিলেটে একদিনে এটা সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এর আগেও গত ২৫ এপ্রিল সিলেট বিভাগে করোনায় সংক্রমিত হয়ে একই সংখ্যক রোগীর মৃত্যু হয়েছিল।স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. সুলতানা রাজিয়া জানান, সিলেট বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫৩ জন সংক্রমিত হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে এবিভাগে করোনায় সংক্রমিত মোট ৪২৪ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
এর মধ্যে সিলেট জেলায় ৩৯৬ জান। বাকি ২৮ জনের মধ্যে সুনামগঞ্জে ৭ জন, হবিগঞ্জে ৬ ও মৌলভীবাজার জেলায় ১৫ জন বলে জানান তিনি। ডা. সুলতানা জানান, মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে বিভাগের চার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার বেশি হবিগঞ্জ জেলায়। এই জেলায় ১২০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৫৪ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার এ জেলায় ৪৫ শতাংশ।মৌলভীবাজারে ১৬৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬১ জনের শরীরে করোনা ধরা পড়ে। এ জেলায় শনাক্তের হার ৩৬ দশমিক ৯৭। তৃতীয় অবস্থানে আছে সিলেট জেলা। এ জেলায় ৩৭৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১১৭ জনের শরীরে করোনার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
আর সুনামগঞ্জের ৮৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২১ জনের করোনার শনাক্ত হয়। এ জেলায় শনাক্তের হার ২৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।আর সিলেটে একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল চলতি মাসের ১ জুলাই। সিলেট বিভাগে গত চব্বিশ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ৮ জনের মৃত্যু নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৯১ জনে। একই সময়ে সিলেট বিভাগে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে আরও ২৫৩ জনের শরীরে। -জাগো নিউজ
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৯৬ বার