সিলেটে যে লড়াইয়ে কামরান-মিসবাহ
ওয়েছ খছরু:: সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন অ্যাডভোকেট মিসবাহউদ্দিন সিরাজ। সিলেট আওয়ামী লীগের ‘চার খলিফা’র সিরিয়ালে চতুর্থ নম্বর ছিলেন তিনি। ভাগ্য তাকে টেনে তুলে নেয় উপরে। এক লাফেই হয়ে যান কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। সেই থেকে মিসবাহ সিরাজ হয়ে ওঠেন সিলেট বিভাগ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট থেকে ঢাকার রাজনীতিতে পা মাড়াতে শুরু করেন তিনি। পরপর দুইবার ছিলেন সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এতেও সিলেটে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারেননি তিনি। বিষয়টি নজরে আসে কেন্দ্রের নেতাদের। মিসবাহের নেতৃত্বে থাকা সিলেট আওয়ামী লীগের কর্মকা-ে দেখা দেয় নানা অসঙ্গতি। দলের ভেতরের সঙ্গতি দূর করতে মিসবাহকে সরিয়ে সিলেট বিভাগ থেকে ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপরও সিলেট ‘প্রীতি’ কমেনি মিসবাহর। সিলেটেই তার সব। কামরান এক যুগ আগেও ছিলেন সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। সাবেক নেতা অ্যাডভোকেট আবু নছর, আ.ন.ম শফিকুল হক ও ইফতেখার হোসেন শামীমের হাত ঘুরে তার হাতেই চলে আসে সিলেট আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব। সিলেট মহানগরের সভাপতি হলেও পরবর্তীতে মিসবাহকে সিলেট বিভাগ থেকে সরানোর সময়কালেই কামরানকে করা হয় দলের কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী সদস্য। এরপর থেকে কামরান শুধু সিলেট নয়, গোটা বিভাগের রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরপর দুইবার নিজ দলের নেতাদের আত্মঘাতী ভূমিকার কারণে সিটি নির্বাচনে হেরেছেন। এরপরও আওয়ামী লীগকে নিয়েই তিনি সরব রয়েছেন রাজনীতিতে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অনেক হিসাব বাকি থাকলেও দলের প্রয়োজনে তিনি কাজ করে চলেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন ও কাউন্সিল সামনে। এই সম্মেলন ও কাউন্সিলকে ঘিরে সিলেটের এই দুই নেতা হচ্ছেন মুখোমুখি। মুখ ফুটে না বললেও তাদের কর্মী সমর্থকরা এরই মধ্যে সরব হয়ে উঠেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের নিয়ে চলছে আলোচনা। আর এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে- কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ নিয়ে। সিলেট বিভাগ থেকে একজন নেতা পাবেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। সেখানে মিসবাহ তার কর্তৃত্ব ধরে রাখবেন না, কামরান এসে জায়গাজুড়ে নিবেন- সেই আলোচনা এখন তুঙ্গে। সিলেটে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এক যুগ ধরেই ত্রিধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে দুটি অংশের নেতৃত্বে রয়েছে মিসবাহ ও কামরান। আর অন্যটি হচ্ছে সিলেটে মন্ত্রী পরিবারকে ঘিরে। তবে- ত্রিধারায় বিভক্ত থাকলেও দ্বন্দ্ব ততোটা প্রকাশ্যে নেই। সবাই মিলেমিশে দলীয় কার্যক্রম চালাচ্ছেন। বতর্মান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম যে কাউন্সিল হয় সেই কাউন্সিলে অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। সাংগঠনিক হওয়ার পর প্রথম প্রথম কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সরব থাকেন। কেন্দ্রে অবস্থান সুসংহত হওয়ার পর তিনি সিলেটের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব দেয়া শুরু করেন। শুধু দলীয় নয়, ক্ষমতার রাজনীতিতেও তিনি ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। এ কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের বিরোধী বলয়কে কাছে টেনে সিলেটে নতুন বলয় তৈরি করেন। নিজের বলয়কে নিয়েও রাজনীতি সুসংহত করতে চালান নানা কা- কারবার। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানসহ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীকে অতিথি করায় বাগড়া দেন তিনি। এতে করে কয়েকটি অনুষ্ঠানও প- হয়ে যায়। এসব কারণে সিলেটের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তুমুল বিতর্কিত হন তিনি। এ ছাড়া সিলেটের পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। এখনো সেই দায়িত্বে রয়েছে। দলের নেতারা অভিযোগ করেন- জামিন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে সিলেটে সরকার বিরোধী অংশের নেতাকর্মীরা মিসবাহ সিরাজের সহযোগিতা পান বেশি। এতে সুবিধা নেয়ার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। এ কারণে রাজনীতিতে মিসবাহ সিরাজ বার বার বিতর্কিত হন। পাশাপাশি ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থিত মেয়র প্রার্থী কামরানের বিরুদ্ধে অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন দলীয় নেতারা। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও অনুরূপভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। দলের নেতাকর্মীরা এবার অভিযোগ তুলেন নগরীর ১০ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে যে ভোট পেয়ে মিসবাহ সিরাজের ভাগিনা জয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী কামরান ততো ভোট পাননি। দলীয় ফোরামেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এদিকে- মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ আওয়ামী লীগের গত কাউন্সিল থেকে ময়মনসিংহ বিভাগ আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা। কিন্তু তিনি অবস্থান করেন সিলেটে। জরুরি প্রয়োজনে ময়মনসিংহের নেতারা তার সঙ্গে এসে সিলেটে কিংবা ঢাকায় দেখা করেন। এ কারণে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তিরস্কৃত হন মিসবাহ। কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ কয়েকজন নেতা তার ওপরও ক্ষোভ ঝাড়েন। তার বক্তব্যের জবাবও দেন তারা। দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয় বরণের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আরো বেশি সক্রিয় হয়েছে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। ২০১৮ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর তিনি নিজে ঢাকায় গিয়ে দলীয় প্রধানের কাছে মনের ক্ষোভ জানিয়ে আসেন। সিলেটের নেতাদের ভূমিকার বিষয়টিও তিনি অবগত করেন। এরপর কেন্দ্র থেকে সিলেটের কয়েকজন নেতাকে শোকজ নোটিশও দেয়া হয়েছিল। সিটি করপোরেশনে হেরে গেলেও কখনো প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেননি কামরান। বরং তিনি দলের প্রয়োজনে সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে চলছেন। গত সংসদ নির্বাচনে কামরান সিলেট-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. একে আবদুল মোমেনের বিজয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় তিনি নির্বাচন পরিচালনাও করেন। এর বাইরে সিলেটের ১৯টি আসনে তিনি নৌকা কিংবা জোটের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। কামরানের উপস্থিতি ও প্রচারণা দলের ভেতরে ঐক্যবদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। গত উপজেলা নির্বাচনেও কামরান দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। দুই সপ্তাহ আগে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সিলেটে পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা। জেলার সভায় তুমুল হট্টগোল, নেতাদের মাইক টানাটানি ঘটনা ঘটলেও মহানগরে ছিল শান্ত পরিবেশ। আর এ পরিবেশের কারণে কামরান কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এখন কেন্দ্রীয় সদস্য কামরান। দীর্ঘদিন টেনেছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগকে। সভাপতি পদে এখনো নতুনরা উঁকি দিচ্ছেন না। কামরানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে এখনো কারো মুখ থেকে ঘোষণা আসেনি। অনুসারীরা জানিয়েছেন- সিলেট বিভাগের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত তিনি। মুখ খুলে না বললেও তার সরব কর্মকা- এমনটি বলছে। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ঘিরে অনুসারীরা সরব হচ্ছেন। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ। কোনো কথা বলছেন না। মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘আমি তো কাজ করছি। সভানেত্রী যে কাজ দেবেন সেই কাজ আমি করবো। জীবনের শেষ সময়ে এসে এখন চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই বলে জানান।’