‘সুজাতা’র জীবনের গল্প
রূপালি পর্দার প্রথম ‘রূপবান’ তিনি। আছে আরো অনেক স্মরণীয় চরিত্র। সংসারও করেছেন এক নায়কের সঙ্গে (আজিম)। এখনো অভিনয় করে চলেছেন ‘সুজাতা’। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। সে উপলক্ষে এই অভিনেত্রীর জীবনের গল্প শুনেছেন ওমর শাহেদ।
আপনি তো জমিদার বাড়ির মেয়ে?
আমি তন্দ্রা মজুমদার, এখন লোকে ‘সুজাতা আজিম’ নামেই চেনে। আমি কুষ্টিয়ার থানাপাড়া জমিদার বাড়ির মেয়ে। আমার জন্ম ১০ আগস্ট। জন্মের মাত্র ছয় মাস পর বাবা আমাদের এতিম করে ভগবানের কাছে চলে যান। আমাদের বিরাট জমিদার বাড়িটি কয়েক বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। এত বড় বাড়ি পুরো অঞ্চলে মনে হয় একমাত্র আমাদেরই ছিল। সে বাড়িতেই শৈশব কেটেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা বাবার শোকে কয়েক বছর অর্ধপাগল ছিলেন। মা মাত্র ২৭-২৮ বছরে বিধবা হয়েছিলেন। অথচ এই বয়সে অনেক মেয়ে এখন বিয়েই করে না। এলাকার কুচক্রী, স্বার্থান্বেষী ফয়েজ চৌধুরী ও তার বড় ভাই মায়ের এ অবস্থার সুযোগ নিল।
তারা আমাদের পরিবারের সবাইকে নানা রকম ভয় দেখানো শুরু করল। মানসিক অত্যাচারও করতে লাগল। হিন্দু পরিবারের মানুষ বলে আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতে লাগলাম। একপর্যায়ে ফয়েজ চৌধুরীর ভয়ভীতি প্রদর্শন, অত্যাচার খুব বেড়ে গেল। তারা আমাদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করল। আমাদের পৈতৃক ভিটা দখল করে বসল। মা আর আমরা ভাই-বোনেরা সবাই কাঁদতে কাঁদতে সেই বিরাট বাড়ি ছেড়ে ভাঙা একটি একতলা ঘরে বসবাস শুরু করলাম। এই হলো আমার উত্থান-পতনে ভরা জীবনের শুরু। এখনো সে বাড়িটি আমাদের দখলে আসেনি। এ বিষয়টি আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সেই সঙ্গে আমাদের কুষ্টিয়ার এমপি হানিফ ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।
অভিনয়ের নেশা কিভাবে হলো?
মা এই দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কিছুদিন পর আমাদের নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমালেন। আমরা প্রথমে পুরান ঢাকায় উঠলাম। তারপর ৪০ টাকা বাড়িভাড়ায় নতুন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে চলে এলাম। একদিন আলাপ প্রসঙ্গে সেই বাড়ির বাড়িওয়ালার ভাই মাকে বললেন, তাঁর সঙ্গে মঞ্চের পরিচালক আমজাদ হোসেনের পরিচয় আছে। মা তাঁকে অনুরোধ করে বললেন, বাবা আমার ছোট মেয়েটাকে যদি অভিনয়ে দিতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। মায়ের অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল, তাঁর কোনো একটি সন্তান ছবির জগতে আসুক। তিনি উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসতেন। সেসব দেখেই তিনি এই জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি আমাকেও এসব সিনেমা দেখতে উত্সাহিত করতেন। এমনকি আমার মা বাড়িতে সুচিত্রা সেনের অনুকরণে অভিনয়ও করতেন। একটু বড় হয়ে আমিও যখন সুচিত্রা-উত্তমের ছবি দেখতে শুরু করলাম, তখন থেকে মাকে আমার ‘গুরু’ আর সুচিত্রা সেনকে ‘আদর্শ’ হিসেবে মেনে এসেছি। তারপর তো আমজাদ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি আমাকে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলেন। ঢাকায় অনেক মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছি। পরবর্তীকালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা, নারায়ণ চক্রবর্তী, আমজাদ হোসেনের অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। নাজমুল হুদা বাচ্চু, ইউসুফ ইমাম, ইমাম ভাই নামে এক ভদ্রলোকের নাটকেও কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এসব মানুষের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।
সিনেমায় কিভাবে এলেন?
‘রূপবান’খ্যাত সালাহউদ্দিন সাহেব তাঁর ‘ধারাপাত’ সিনেমার জন্য একটি নতুন মুখ খুঁজছিলেন। আমজাদ ভাই তখন তাঁর সহকারী পরিচালক ছিলেন। যত দূর মনে পড়ে, তখনই আমি আমজাদ ভাই পরিচালিত ‘মায়ামৃগ’ নাটকে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। তিনি আমার কথা সালাহউদ্দিন সাহেবকে বললেন। ধারাপাতের পরিচালক নাটকটির মঞ্চায়নের দিন আমার অভিনয় দেখতে এলেন। আমাকে দেখে তাঁর পছন্দ হলো। অভিনয়ও ভালো লাগল। এর পরই তাঁর সিনেমায় নায়িকা চরিত্রে মনোনীত করলেন। তবে সিনেমায় একটি নাচের দৃশ্যের মাধ্যমে আমার প্রথম আগমন। সেই ছবিটির নাম ছিল ‘দুই দিগন্ত’; কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে প্রথম মুক্তি পেয়েছে ‘ধারাপাত’। এই আমার পথচলা শুরু হলো।
‘রূপবান’-এ অভিনয়ের কথা মনে পড়ে?
আমার সিনেমায় অভিনয়ও সালাহউদ্দিন সাহেবের ভালো লাগল। আমি তাঁকে মামা ডাকতাম। সালাহউদ্দিন মামা কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি খুব দেশপ্রেমিক ছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও ছাত্রদের জীবনদান এই শিক্ষককে আন্দোলিত করেছিল। ১৯৫৫ সালে তিনি যে ‘রূপবান’ নামের ছবি তৈরি করলেন, সেটির পেছনেও তাঁর এই দেশপ্রেমই প্রধান ছিল। তখন পুরো পূর্ব পাকিস্তানেই উর্দু ছবি বানানোর হিড়িক চলছিল। এই বাংলার মানুষকে বাংলা ছবি দেখতে আগ্রহী করে তুলতে তিনি একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সালাহউদ্দিন মামা দৃঢ় মনোবল নিয়ে উর্দু ছবিকে সরিয়ে আবার বাংলা ছবিকে সবার মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের দেশের যাত্রা-লোকগাথা ‘রূপবান’কে নিয়ে দর্শকদের সামনে হাজির হলেন। এ দেশের মানুষের রক্তের ভেতরে প্রবাহিত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ডালিম কুমার’, ‘কেশবতী কন্যা’র মতো লোকগাথা থেকে গল্প নিয়ে তিনি ছবি বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই ছবিটিই হলো ‘রূপবান’, যার গল্প আমরা ছোটবেলায় মা, দাদির মুখে শুনে বড় হয়েছি। ছবির নায়িকা হিসেবে আমাকে নেবেন সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আমার স্ক্রিনটেস্ট হলো। এই ছবিতে আমি ১২ দিনের ছেলের ১২ বছরের স্ত্রী। এ ছবিটি আমার ক্যারিয়ারের সেরা ছবি হয়ে আছে। এই ছবিতে অভিনয় করার সময় আমাদের অনেক ঝামেলা ও কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এফডিসিতে ঢুকলেই আমাকে দেখে অনেকে বলত, এই দেখ যাত্রার নায়িকা যাচ্ছে। এর কপালে কী আছে কে জানে? অনেকে আবার মুখটিপে হাসত। তার পরও আমরা ছবিটির কাজ ভালোভাবেই শেষ করতে পেরেছিলাম। সিলেটে গিয়ে দেড় মাস শুটিং করলাম। তারপর ঢাকায় এসে এফডিসিতে শুটিং করলাম। এরপর নবাবপুরের একটি বাড়ির ছাদেও শুটিং হলো। তবে আমি এবং আমার মায়ের ভয় ছিল যে রূপবান নিয়ে চারদিকে এত যে সমালোচনা শুনছি, তাতে ছবিটি মুক্তি পেলে আর কোনো ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পাব তো?
সিনেমাটি মুক্তির পর?
তবে আমাদের সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ছবিটি এক অভাবনীয় ব্যাপার ঘটাল। প্রতিটি হলে এত লোক সমাগম, এত ভিড় হলো, যা আগে কোনো দিন হয়নি। মাসকে মাস ‘রূপবান’ একেকটা সিনেমা হলে চলেছে। সেই সময়ে কোনো উর্দু বা বাংলা ছবিই রূপবানকে বিট করতে পারেনি। ছবিটির জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে আমারও জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল। তারপর থেকে একটার পর একটা সিনেমায় সই করতে থাকলাম।
রূপবানকে ঘিরে তো আপনার অনেক স্মৃতি।
অনেক স্মৃতি আছে। যেমন—আমরা সিলেট থেকে ফিরছি। ট্রেন দেরিতে আসবে জেনে স্টেশন মাস্টার আমাকে, মাকে আর চন্দনাকে (‘রূপবান’-এর তাজেল) তাঁর রুমে খাতির করে বসতে দিলেন। আমরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর ১০-১২ জন মহিলা ফুলের মালা, পূজার থালা, পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে আমাদের রুমে এলেন। আমরা তো অবাক। তাঁরা এসেই আমাকে পূজা করতে লাগলেন। আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। মায়ের দিকে তাকালাম, মা আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে ইশারা করলেন। পূজা শেষে আমাকে প্রণাম করে চলে যাওয়ার সময় মহিলারা হাসিমুখে বললেন, ‘আমরা একজন সতীসাধ্বী মহিলার দেখা পেলাম, আমাদের জীবন ধন্য। ’ মাকে বললাম, মা তুমি ওঁদের নিষেধ করলে না কেন? তিনি বললেন, দেখ, ওদের বিশ্বাস যে তুই সতী। কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হতো। এ রকম অনেক ঘটনা আছে।
এরপর তো অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন?
তারপর একে একে ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘মোমের আলো’, ‘মেঘভাঙা রোদ’, ‘ডাক বাবু’, ‘মধুমালা’, ‘সাইফুলমুলক বদিউজ্জামান’সহ আরো অনেক সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হলাম। আমার নামকরা ছবির মধ্যে আরো আছে—নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘এতটুকু আশা’, মহিউদ্দিন ভাইয়ের ‘গাজী-কালু-চম্পাবতী’, খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘রাজাসন্ন্যাসী’, নুরুল হক বাচ্চুর ‘বড় বউ’, বশির আহমদের ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’, সফদার আলী ভুঁইয়ার ‘কাঞ্চন মালা’, ইবনে মিজানের ‘জরিনা সুন্দরী, ‘নাগিনীর প্রেম’, নাজমুল হুদা মিঠুর ‘অনেক প্রেম অনেক জ্বালা’, কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’, আজিম সাহেব পরিচালিত ‘টাকার খেলা’, ‘প্রতিনিধি’, ‘বদলা’, নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’, হাসান ইমাম পরিচালিত ‘লালন শাহ’, ইবনে মিজান পরিচালিত ‘তিতুমীর’, ‘নাগিনীর প্রেম’, ‘আমির সওদাগর’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী’, রাজ্জাক পরিচালিত ‘বেঈমান’, ‘আপনজন’, সুমিতাদির (দেবী) ‘মোমের আলো’, ‘মায়ার সংসার’, ‘আদর্শ ছাপাখানা’ ইত্যাদি।
নায়ক আজিমের সঙ্গে বিয়ে হলো কবে?
১৯৬৭ সালের জুলাইয়ে আজিম সাহেবের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পরও সিনেমায় অভিনয় করেছি। আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনো বাধা আসেনি। যদিও আমার শাশুড়ি একটু পর্দা করতেন। তবে কোনো দিন আমি মেকআপ মুখে শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে যাইনি। তাঁরাও আমাকে মেয়ের মতো স্নেহ করেছেন। বিয়ের ১০ বছর পর ১৯৭৭ সালে আমাদের ঘর আলো করে সন্তান ফয়সাল জন্ম নিল। আমি সংসার ও চলচ্চিত্র—দুটি দিকই একসঙ্গে চালিয়ে গিয়েছি। কোনো অসুবিধা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তো ঢাকায় ছিলেন?
হ্যাঁ। এখনকার বঙ্গভবনটি পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট হাউস ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়ানক কালরাত্রিতে সেখান থেকে রাত ১২টার পরে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া গেল, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। সকালে উঠে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দেখি, নিচের বারান্দায় ছোপ ছোপ রক্ত। দুটি কাক সেই রক্ত খাচ্ছে। দৌড়ে ভেতরে এলাম, সবাইকে বললাম। তারা গিয়ে দেখল। বুঝতে পারলাম, কেউ একজন আহত হয়ে আমাদের বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভোরের আলো ফোটার পর নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। তারপর আস্তে আস্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কার্যকলাপ জানতে পারলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিম সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা-পয়সা, কাপড়, ওষুধপত্র দিয়ে সাহায্য করতেন। তাঁদের সাহায্য করার জন্য এক মাস আগে তিনি আমাকে যে নতুন গাড়িটি কিনে দিয়েছিলেন, সেটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেই টাকা-পয়সা তিনি তাঁদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমার শাশুড়ি কিছু বলাতে তিনি বললেন, ‘মা আমি যদি টাকা না দিতে পারি, ওদের খুব কষ্ট হবে। ওরা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে। ’ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অপরাধে হানাদার বাহিনী বাড়ির সামনে থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ওদের কাছে খবর ছিল, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেড় মাস পর ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে আর্মির কর্নেল, ক্যাপ্টেন, মেজরদের হাত-পা ধরে তাঁকে ছাড়িয়ে আনলাম। ওই দেড় মাস তিনি কোনো দিন খেয়ে, কোনো দিন না খেয়ে, আর্মির হাতে মার খেয়ে বেঁচে ছিলেন। ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর আমরা ভারতে চলে গেলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার আমরা যে যার কাজে ফিরে এলাম।
কোনো প্রিয় পরিচালকের কথা মনে পড়ে?
জনপ্রিয় ও নামকরা পরিচালক ছিলেন কাজী জহির। তাঁর মনের মতো অভিনয় যতক্ষণ না হতো, ততক্ষণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তিনি ছাড়তেন না। আমরা যারা তাঁর ছবিতে অভিনয় করেছি, তারা জানি, একটি দৃশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছয়-সাতবারও টেক দিতে হয়েছে। যতই নামকরা নায়ক-নায়িকা হোন না কেন, জহির ভাই কাউকেই ছাড় দেননি। তবে এই মানুষটিই আবার শিল্পীদের সম্মানীর ব্যাপারে খুব সজাগ ছিলেন। একটি ছবিতে আমি পারিশ্রমিক নিতে একটু দেরি করে ফেলেছিলাম। এক দিন তিনি ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সুজাতা, তোমার টাকা নেবে, নাকি খরচ করে ফেলব?’ তিনিই আমাদের পারিশ্রমিকের কথা মনে করিয়ে দিতেন। একটা সময় ছিল, যখন কাজী জহির মানেই ‘হিট’। তাঁর ছবিতে অভিনয় করার জন্য তখন আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম।
শুটিংয়ের কোনো স্মরণীয় দৃশ্য?
‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’ সিনেমার একটি ঘটনা বলি। এই ছবির শুটিং হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। পরিচালক ছিলেন ইবনে মিজান। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে শুটিং করবেন বলে আমাদের কাছ থেকে শিডিউল নিলেন। আমরা যথারীতি সেখানে গেলাম এবং একটি হোটেলে উঠলাম। পশ্চিম পাকিস্তানের সাপুড়েরা ছবির জন্য প্রয়োজনীয় সাপ সরবরাহ করতে পারবে না বলে মিজান ভাই সাপের খোঁজে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। তিনি কী পরিমাণ সাপ জোগাড় করে এনেছেন, তার কিছুই আমরা জানি না। আমরা শুটিংয়ের জন্য যথারীতি একটি ফিল্ম স্টুডিওতে গেলাম। মেকআপরুমে বসে আছি, এমন সময় মিজান ভাই ‘সালোনি’ নামের ওখানকার এক অভিনেত্রীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁকে বেশ মিশুক বলে মনে হলো। তাঁর নাকটি একটু চ্যাপ্টা ধরনের। তিনি মনে করলেন, আমার নাকটিও তেমন। এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টার পর তিনি আমাকে তাঁর ছোট বোন বানিয়ে ফেললেন। এর মধ্যে মেকআপ নেওয়া হয়ে গেল। মিজান ভাই সেটে যেতে বললেন। ছবির সেই দৃশ্যের জন্য একটি শোবার ঘরের আদলে সেট বানানো হয়েছিল। দৃশ্যটি ছিল—রাজকন্যা বিছানায় শুয়ে আছে, পাহারাদার সাপগুলো তাকে পাহারা দিচ্ছে। মিজান ভাই দৃশ্যটি বুঝিয়ে দেওয়ার সময় খেয়াল করলেন, আমি টেনশন করছি। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, ‘সাপ বেশি নয়, কয়েকটি মাত্র। তুমি শুয়ে আছো আর তোমার শরীরের ওপর দিয়ে একটি অজগর সাপ আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে—এমন একটি দৃশ্যের শুটিং করব। ভয় পেয়ো না, বেশিক্ষণ লাগবে না। ’ বিশাল সেটের দরজা আমরা হাজির হওয়ার পর খুলে দেওয়া হলো। তবে ভেতরে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে একেবারে চমকে গেলাম, অনেক সাপ কিলবিল করছে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে চিত্কার করে উঠলাম, মিজান ভাই! এত সাপ! তিনি মুচকি হাসলেন। সাপুড়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেট কা আন্ধার কিতনা সাপ হ্যায়? সে উত্তর দিল, এক শ আট! এরপর আর সহ্য হচ্ছিল না। মেঝেতে পা ফেলে যে বিছানার ওপর যাব, তারও উপায় নেই। পরে সাপুড়ে বেঞ্চ পেতে দিয়ে আমাকে বিছানায় যাওয়ার ব্যবস্থা করল। ততক্ষণে মিজান ভাই ক্যামেরা রেডি করে ফেলেছেন। তিনি অ্যাকশন বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। তখনই সাপুড়ে একটি অজগর সাপকে আমার গায়ের ওপর তুলে দিল। আমি ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছি, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু কোনো কিছু বলার উপায় নেই। স্রেফ মনের জোরে টিকে আছি। ওদিকে সাপ আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে আমার গলার কাছে এসে নিজের জিব দিয়ে আমার গলা, গাল স্পর্শ করল। এরপর আর সে মোটেও নড়াচড়া করে না। এদিকে ভয়ে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। শটটি এনজি (নো গুড) হলো। আবার একটি শট নেওয়া হলো। আমি অনেক কষ্টে শুয়ে আছি। দ্বিতীয়বার অজগরটি ঠিকমতো শট দিল।
আর কোনো প্রিয় স্মৃতি?
১৯৭২ সালে ‘এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভাল’ হয়েছিল। সেখানে অংশ নেওয়ার জন্য আমি, আজিম, হাসান ইমাম, জহিরুল হক ও সরকারি কর্মকর্তা ফারুক মিলে প্রথমে মস্কো গেলাম। এরপর তাসখন্দ। এই উত্সবে ৬৪টি দেশ থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গিয়েছিলেন। তাসখন্দে আমরা রাজ্জাক, কবরী, ববিতার সঙ্গে মিলে উত্সবে অংশ নিলাম। বোম্বে থেকে রাজ কাপুর ও ঋষি কাপুর উত্সবে এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। একদিন রাত ৮টার সময় হোটেলের রুমে কেউ একজন নক করলেন। দরজা খুলে দেখি, ঋষি কাপুর দাঁড়িয়ে আছেন। ফর্সা, ছিপছিপে অসাধারণ সুন্দর এই অভিনেতা আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি সুজাতা?’ জি। ‘রুমে একটি শ্যাম্পেনের বোতল আছে, আজিম ভাই সেটি দিতে বলেছেন। ’ আমি বোতলটি তাঁর হাতে তুলে দিলাম। তাঁরা ‘ববি’ ছবিটি নিয়ে উত্সবে এসেছিলেন। বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে এমন আরো অনেক স্মৃতি আছে।
নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গেও তো অনেক ছবি করেছেন।
সিলেটে একটি চাবাগানে ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ ছবিটির শুটিং হয়েছিল। মেঘলা আকাশের জন্য ক্যামেরাম্যান কামাল ভাই শুটিং করতে পারছিলেন না। এমন আবহাওয়া টানা কয়েক দিন ছিল। তখন আমি, রাজ্জাক, পরিচালক নারায়ণদা (নারায়ণ চক্রবর্তী) সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই মিলে তাস খেলতে বসে যেতাম। এটি ১৯৭০ সালের ঘটনা। তখন দক্ষিণে যে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল, আমরা টেরটিও পাইনি। কারণ তখন যোগাযোগব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। খবরের কাগজ পৌঁছতে সময় লাগত। আকাশের মেঘলা অবস্থা ১২ দিন পরে কেটেছিল। সেই সময়ের মধ্যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। এই ছবিতে খুরশিদ আলমের কণ্ঠে রাজ্জাকের ঠোঁটে যাঁরা ‘ও দুটি নয়নে, স্বপনে চয়নে’ গানটি শুনেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ছবিটির কথা ভুলতে পারবেন না। এই গানটির শুটিংয়েও অনেক মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমি আর রাজ্জাক পাহাড়ের ওপর বসে আছি। কামাল ভাই ক্যামেরা রেডি করছেন। রাজ্জাক একটু দুষ্টু ছিল। কো-আর্টিস্টদের সঙ্গে সারাক্ষণ সে মজা করত, সবাইকে হাসি-খুশি রাখত। সিলেট কিন্তু চিনা জোঁকের জন্য বিখ্যাত। রাজ্জাক জানত, আমি জোঁককে খুব ভয় পাই। তার পরও সে আমার পাশে বসে একের পর জোঁকের গল্প করে চলেছে আর আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। সে বলছে—‘ম্যাডাম, সিলেটের এই চিনা জোঁক কিন্তু খুব বিপজ্জনক। একবার যদি আপনাকে কামড়ে ধরে, তাহলে আর ছুটতে পারবেন না। ’ আমি তো ভয়ে শিউরে উঠছি, এর মধ্যে একটি জোঁক আমার গায়ে উঠে গেল। সেটি আমি নই, রাজ্জাকই খেয়াল করল। বলল, ‘আপনি একটুও নড়বেন না। আপনার গায়ে জোঁক উঠে গেছে। ’ তবে ভয়ে অনেক লোকের সামনেই মোড়া থেকে উঠে আমি লাফাতে শুরু করলাম। রাজ্জাক তখন উপস্থিত বুদ্ধিতে আমাকে শান্ত করল, ‘আপনি চুপ করে বসুন। নইলে আমি জোঁকটি ফেলব কী করে?’ এরপর শুটিংয়ের জিপের ড্রাইভার আমার বাঁ কানের নিচ থেকে জোঁকটি ধরে ফেলে দিল। সহশিল্পী হিসেবে রাজ্জাক খূবই আন্তরিক ও সহযোগিতাপরায়ণ ছিল। তার সঙ্গে অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছি। সেগুলোর প্রায় সবই জনপ্রিয় হয়েছে। রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে আমরা কেউ বোর ফিল করতাম না।
আপনার স্বামীও তো বিখ্যাত অভিনেতা।
আজিম সাহেব একজন নামকরা অভিনেতা ছিলেন। তিনি পরিচালনাও করেছেন। তিনি খুব সাহসী ও পরোপকারী ছিলেন। এফডিসিতে তাঁর গুণের কারণে সবাই তাঁকে ‘আজিম ভাই’ বলে ডাকতেন। পাকিস্তান আমলে এফডিসি থেকে বাড়ি ফেরার জন্য রাত ৩টা-৪টার সময় গাড়ি পাওয়া যেত না। তখন এত গণপরিবহনও ছিল না। আজিম সাহেব এফডিসির একমাত্র নায়ক, যিনি মাঝেমধ্যে কোনো জুনিয়র বা কোনো শিল্পীর যাওয়ার ব্যবস্থা নেই দেখলে নিজের গাড়িতেই তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। এফডিসির অনেক লাইটম্যান আছেন, যাঁদের আজিম সাহেব নিজের টাকা খরচ করে বিদেশে কাজ করতে পাঠিয়েছেন। তাঁদের সংসার এখন ভালো চলছে। এই সত্যটিও এফডিসির অনেকেই জানেন—কারো খাবারের পয়সা নেই, ওষুধ কেনার টাকা নেই, শুনলে আজিম সাহেব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাড়িতে মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান দেখাশোনা, নিজের কাজ—এত কিছুর মাঝেও তিনি তাঁদের দেখাশোনা করেছেন। তিনিই সেই আমলের একমাত্র নায়ক ছিলেন, যিনি সকালে পূর্ব পাকিস্তান আর বিকেলে পশ্চিম পাকিস্তানে শুটিং করেছেন। তাঁর পকেটে সব সময় প্লেনের টিকিট থাকত। নায়ক জসিম, ফাইটার মোসলেমদের ফাইটিং গ্রুপের নাম ছিল জেমস গ্রুপ। এই গ্রুপের ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিটি তিনি তাঁর পকেটের টাকায় বানিয়ে দিয়েছিলেন। এই তথ্যটি আমারও জানা ছিল না। একবার এফডিসিতে নায়ক মান্নার একটি সিনেমা করতে গিয়েছিলাম। তখন ফাইটার মোসলেম আমাকে বলল, “ভাবি, আপনি হয়তো জানেন না, আজিম ভাই আমাদের জেমস গ্রুপের ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির সব খরচ দিয়েছিলেন। ফলে এই ছবিটি তৈরি করতে আমাদের মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। ” কথাটি শুনে আমি অবাক হইনি। কারণ কোনো মানুষের উপকার করলে সেটি আর কাউকে জানানো তাঁর স্বভাব ছিল না। এফডিসিকে তিনি অনেক পরিচালক উপহার দিয়েছেন। আমাদের এফডিসির অনেকে এখনো বলেন, বাসায় গেলে আজিম কাউকে না খাইয়ে ছাড়েননি। আমার স্বামী মানুষ হিসেবে বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন। তবে ২০০৩ সালে তিনি আমাদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে পরপারে চলে গেলেন। এখন আমি ছেলে, ছেলের বউ, দুই নাতি নিয়ে সংসারের মায়ায় জড়িয়ে আছি।
আপনার সময়ের অনেকেই অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন।
আমি এখনো অভিনয় করে যাচ্ছি, কারণ অভিনয়কে ভালোবাসি। আমি এখন একা হয়ে গিয়েছি। আমার ছেলে বড় হয়েছে, তার কাজকর্ম আছে। নাতিরাও বেশ বড় হয়ে গেছে। তারা আমাকে কতটুকুই বা সময় দিতে পারে? এই আশা করাও আমার অন্যায়। তাদের নিজস্ব জগত্ আছে। এসব কারণেই আমি কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চাই। তা ছাড়া সবারই তো টাকার প্রয়োজন, তাই না? ফলে ঘরে বসে স্মৃতি মন্থন করার চেয়ে বাইরে সবার সঙ্গে গল্প করে, শুটিং করে কাটিয়ে দেওয়াই ভালো মনে করি। তাই এখনো আমি কাজ করে যাচ্ছি। নতুন পরিচালকরা ডাকলে তাঁদের আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করব এবং কাজ করব।
(৮ আগস্ট ২০১৭, মহানগর প্রজেক্ট, রামপুরা, ঢাকা। )