হাওরে ভেসে থাকা আগুনে পুড়া ঝলসানো লাশ, পতিত জমিতে পড়ে থাকা বিকৃত পোকাধরা লাশ, বিছানায় পড়া অবস্থায় রক্তাক্ত মৃতদেহ, নির্জন ধানি জমিতে পঁচাগলা মরদেহ, নদীতে ভাসমান বস্তাবন্ধী লাশসহ বিভিন্ন উপায়ে করা হয়েছিল এমন একাধিক হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডের রহস্য ও আলামত নষ্ট করতে নানা উপায় অনুসরণ করে চতুর ঘাতকরা। যার ফলে হত্যার কারণ ও হত্যাকারী সম্পর্কে ধোঁয়াশার মধ্যে পড়তে হয়েছিল স্বজন হারা পরিবার ও মামলার তদন্তে নিয়োজিত পুলিশের।
‘খুনের স্বাক্ষী বনে দেয়’ গ্রাম্য এই প্রবাদের বাস্তবিক রূপ পেয়েছে সুনামগঞ্জে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ড উদঘাটনে। কোনো ধরণের তথ্য উপাত্ত্ব ছাড়াই কেবল আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্তত ৮ টি ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে হত্যাকারীর গতিবিধি লক্ষ্য করে এসব হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সনাক্ত করে আইনের নিয়ে এসেছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশের এমন অর্জনকে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির ইতিবাচক মাইলফলক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। যা পুলিশের ভাবমূর্তি সমন্নত রাখার পাশাপাশি অপরাধ ধমনে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তারা।
সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮টি‘র বেশি ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এসব মামলা তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
জানা যায়, ৩০ জানুয়ারি শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রাম সংলগ্ন বরাম হাওরের কান্দা থেকে আগুনে পুড়া ঝলাসানো এক অজ্ঞাতনামা যুবকের লাশ উদ্ধার করে শাল্লা থানার পুলিশ। অজ্ঞাতনামা যুবককে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে দাহ্য পদার্থ দিয়ে মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে আলমত গোপনের চেষ্টা করা হয়। তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে হত্যার সাথে জড়িত ১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৪ মার্চ ছাতক পৌরসভার বাঘবাড়ি এলাকায় পতিত জমিতে মুখমণ্ডল বিকৃত গলায় ক্ষত অবস্থায় পোকা ধরা ১৮-২৫ বছর বয়সী এক অজ্ঞাত নামা যুবদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খুনের আলামত গুম করতে একই কায়দায় দাহ্য পদার্থ দ্বারা আগুন দিয়ে মৃত ব্যক্তির মুখমন্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান ঝলসানো হয়। লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে এমনটা করা হলেও ক্লু-লেস এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ।
তদান্তাধীন এই মামলায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৩ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২২ এপ্রিল সুনামগঞ্জ সদর থানাধীন বিছানায় এক মহিলার রক্তাক্ত মৃত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আত্মীয়ের বাড়িতে হত্যার স্বীকার মধ্যমবয়সী নারীর হত্যা মামলায় নানা ধুমরুজাল সৃষ্টি হলেও ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয় পুলিশ। এই ঘটনায় ২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১১ মে জামালগঞ্জ উপজেলার রামনগর গ্রামে সিকন্দর আলী নামে এক অটোরিকশাচালক খুন হন। মাধুখালী হাওরের নির্জন ধানী জমি থেকে ভিকটিমের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ধারালো অস্ত্রের ধারা সিকান্দর আলীকে খুন করা হলেও প্রথম দিকে কোনো ক্লু ছিলনা মামলার বাদী ও পুলিশের হাতে। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটির রহস্য খুব অল্প সময়ে উদঘাটন করে পুলিশ। হত্যার সাথে জড়িত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ৩ জুন দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের জিরারগাঁও এলাকায় ধানী জমির কাঁদা পড়ে থাকতে দেখা যায় নূর আলম নামে এক যুবকের লাশ। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের আগে পরে ঘটনার সূত্র ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে হত্যাকারী সনাক্ত করে পুলিশ। হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে ৫ জনতে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৯ জুলাই উপজেলার দারাইন নদীতে ইটের সাথে বস্তায় বাঁধা অবস্থায় ৩০-৩৫ বছরের এক অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডটির রহস্য দ্রুতসময়ে উদঘাটন করে পুলিশ। এই ঘটনায় ১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানা যায়। ১৯ আগস্ট মধ্যনগর এলাকায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সুভাষ চন্দ্র সরকার নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার একদিন আগে নিখোঁজ হওয়া সুভাষের লাশ উদ্ধার করলেও হত্যার রহস্য নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। ক্লু-লেস এই হত্যার রহস্য উদঘাটনে তথ্যপ্রক্তির সাহায্য নেয় পুলিশ। রহস্য উদঘাটন করে হত্যার সাথে জড়িত ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
সম্প্রতি ১৯ সেপ্টেম্বর ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ বাজারের এক ব্যবসায়ির লাশ সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের বুড়াইরগাঁও-পীরপুর রাস্তার পাশে ধানি জমি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। গুপ্ত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য দ্রুত সময়ে উদঘাটন করে পুলিশ। তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অপরাধী সনাক্ত পুলিশের এমন তৎপরতা ও আন্তরিকতাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন সচেনমহলসহ বিশিষ্টজনেরা। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অপরাধ প্রবনতা কমে আসবে বলে মনে করছেন তারা।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান সেলিম বলেন, আগের চেয়ে পুলিশ এখন অনেক তৎপর ও গতিশীল। হত্যার রহস্য উদঘাটনে সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ যেমন ভূমিকা রাখছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। অপরাধ ধমনে পুলিশের এমন ভূমিকা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলে মনে করছেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সভাপতি আইনজীবী হোসেন তৌফিক চৌধুরী বলেন, পুলিশের এমন গতিশীলতা শুভদিক। পুলিশকে আরও পেশাদারিত্বের সহীত অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখতে হবে। কেবল ঘটনা সনাক্ত আর জড়িতদের গেফতার করলেই হবে না দোষী ব্যক্তি যাতে আইনের ফাঁক দিয়ে বের হতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সততা ও নিষ্ঠারসহীত সার্জশীট করতে হবে। অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। কেননা বিচার বিলম্বতা বিচার না পাওয়ার শামিল।
পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান সিলেটভিউকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে যতটি ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ড সংগঠতি হয়েছে তার বেশিরভাগেরই রহস্য উদঘাটন হয়েছে। হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে আওতায় আনা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য ও পুলিশের গোয়েন্দা তৎপরতায় এসব ঘটনা রহস্য উৎঘাটিত হয়েছে বলে জানান তিনি। অপরাধ প্রবনতা ধমনে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়ছে বলেও জানান তিনি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৮০ বার