স্বাধীন দেশে কেমন আছে গফুর-আমিনা?
অশনিসংকেতের দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল ভিন্ন। কিন্তু ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, বাম্পার ফলনও কখনও বিপদ সংকেত হয়ে উঠতে পারে। মানছি এখন খাদ্য পৃথিবীতে যথেষ্টই আছে। উৎপাদনেও সমস্যা নেই। খাদ্য উৎপাদন হল কিন্তু যার যা পাওয়ার, সে তা পেল না- এমন খাদ্য পর্যাপ্ত থেকেও বা লাভ কী? কৃষক অভিমান করে বলেছে, ‘আর করব না ধান চাষ, দেখব তোরা কী খাস?’ এই তীব্র অভিমানের মর্ম নগর নেতারা বুঝলেন না। কৃষকের এই অন্তর্দহনকে তারা নগরবাসীর প্রতি প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ হিসেবে বুঝলেন। কৃষকের এই অভিমান যারা বোঝেন না, তারাই কিন্তু আবার তাদের শ্রেণীর অভিমান বোঝেন। কোনো উঁচুদরের মঞ্চনাটক দলে দলে দর্শক দেখতে না আসলে বোঝেন। কোনো উচ্চমার্গীয় চলচ্চিত্র দেশে কদর না পেয়ে বিদেশে সমাদৃত হলে তা নিয়েও তাদের আফসোসের কমতি পড়ে না। তো এই সব বেদনা অনুভব করার মতো যথেষ্ট আবেগী শক্তি তাদের আছে; কিন্তু কৃষক তার সৃষ্টির মর্যাদা না পেলে তার অভিমান তাদের কাছে নিতান্ত ভাবাবেগ বলে মনে হয়। বাংলাদেশের ‘আধুনিক’ নেতারা কৃষিকে এখনও সভ্যতা ভাবতে পারেননি। কৃষক এখনও তাদের কাছে চাষাই। শিল্পই তাদের কাছে সভ্যতার ভিত্তি। তা সেই ‘শিল্প সভ্যতা’র জন্য যতই পরিবেশগত মূল্য দিতে হোক না কেন।
২.ঠিক, কোনো মানুষই তার নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে পারে না, করতে চায়ও না। তারপরও যখন ধ্বংস করতে হয়, তখন বুঝতে হবে কী নিদারুণ বেদনায় কাজটি তাকে করতে হচ্ছে। নিজের সৃষ্টি ধ্বংস করে দেয়ার প্রচুর উদাহরণও তো আমাদের রয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক ফ্রানৎস কাফকা বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে অনুরোধ করেছিলেন তার যা কিছু সৃষ্টি সব ধ্বংস করে দিতে। ‘প্রিয়তম ম্যাক্স, আমার শেষ অনুরোধ; যা কিছু আমি রেখে যাচ্ছি- এমনকি আমার বইয়ের আলমিরা, লেখার টেবিল, বাসায় ও অফিসে কিংবা যেখানে আমার যে লেখা পাওয়া যায়, তা বই আকারেই হোক, পাণ্ডুলিপি হোক, আমার চিঠি, অন্যের আমাকে লেখা চিঠি, ছোটখাটো কোনো খসড়া রচনা, যা-ই হোক সবকিছু তুমি পুড়িয়ে ফেলবে, একদম শেষ পাতা পর্যন্ত। এমনকি তোমার কাছে আমার যে লেখা ও নোটগুলো আছে তাও। অন্যদের কাছে যা আছে আমার নাম করে সেগুলো তুমি চেয়ে নেবে এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলবে।’ যে তীব্র অভিমানে ফ্রানৎস কাফকা তার সৃষ্টি পুড়িয়ে ফেলতে চান, ওই একই অভিমানে টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার কৃষক আব্দুল হালিম শিকদার ধানের দাম না পেয়ে তার পাকা ধানক্ষেতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। শুধু টাঙ্গাইল নয়, ন্যায্যমূল্য না পেয়ে জয়পুরহাটে ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ক্ষেতমজুর সমিতি। কাফকার দুঃখ তারা বোঝেন, কৃষকের দুঃখ বোঝেন না। ক্ষেতের ধান পোড়ানো যদি নিছক ভাবাবেগ বলে ধরে নেয়া হয়, তবে খুবই ভুল হবে। এ সবের প্রতিক্রিয়া হয় দীর্ঘমেয়াদে।
এক সময় দেখা যাবে, গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষি পরিবারের কৃষকের ছেলে-মেয়েই নেতিবাচক কোনো পেশায় জড়িয়ে পড়বে। পাচার হয়ে যাবে নারীরা। প্রবেশ করবে অন্ধকার কোনো জগতে। সবাই দেখছেন, কৃষকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কৃষিবাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে; তবে সে বাজার পুরোটাই সাম্রাজ্যবাদী। এই সাম্রাজ্যবাদী বাজারের বৈশিষ্ট্য কৃষককে পরনির্ভরশীল করে রাখা আর ফড়িয়া, দালাল এবং মিলমালিকদের মাধ্যম কৃষকের পেটে লাথি মারার ব্যবস্থা করা। কিন্তু কেউ কিছু বলবেন না। শুনতে খারাপ শোনালেও বাস্তবতা তাই। সবাই দেখছেন, বছরান্তে ফলন বাম্পার থেকে বাম্পারতর হচ্ছে। কিন্তু দেখছেন না, কৃষক আটকে আছেন ‘দধিচির চেয়ে বড় সাধক’ উপমার মধ্যে। খালি প্রশংসায় কি পেট ভরে? বরং পেটে থাকলে পিঠেও কিছু সয়। কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিক দাবি করছি কিন্তু বাস্তবে দেখছি ব্যবস্থাপনা পুরোটাই সামন্ততান্ত্রিক, সাম্র্রাজ্যবাদী।
খোদ কৃষিমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করা যাচ্ছে না। সেটুকু আমরা বুঝি না তা নয়; কিন্তু তারও চেয়ে যেটা বোঝা দরকার, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা যায় না যে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে, সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে কৃষকের প্রতিরোধের সীমা কতটুকু? কবেই বা জয় হবে কৃষকের? কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য না পেলে যে আপ্তবাক্যটি সবচেয়ে বেশি আওড়ানো হয়, সেটা এমন ‘প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এই প্রশ্ন কেউ করেন না, যে দেশের মাটি এত উর্বর, যে দেশে পানির কোনো অভাব থাকার কথা নয়, যে মাটিতে কৃষকের ধান চাষের অভিজ্ঞতা কয়েক হাজার বছরের; সেখানে ভর্তুকির প্রশ্ন আসে কেন? গলদ তাহলে কৃষিনীতিতে। বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচের খরচ এত বেশি কেন? এর প্রতিটির সঙ্গে জড়িত বহুজাতিক কোম্পানির বিশাল বাণিজ্য। এর পেছনেও রয়েছে এক কূটরাজনীতি। অফুরান পানির দেশে কৃষককে সেচের জন্য পানির পাম্প ব্যবহার করতে হয়। নদীতে পানি নেই। এসব কথা বলতে গেলে অপবাদ দেয়া হয় ভারতবিদ্বেষী হিসেবে।
৩.বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের তীব্র তাপদাহ, আষাঢ়-শ্রাবণের প্রবল বৃষ্টিতে সৃষ্ট পচা-কাদা কিংবা পৌষ-মাঘের হাড়ে সুঁচ ফোটানো শীত ঘরে বসেও সহ্য করা আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে যায়। আর আমাদের কৃষক ভাইয়েরা প্রত্যেকটি ঋতুর সমস্ত দুর্ভোগ শরীরের শেষ প্রতিরোধ বিন্দু দিয়ে মোকাবেলা করে ফসল ফলান। সেই ফসলের দাম যখন পাওয়া যায় না; তখনও তাদের আমরা সন্তুষ্ট থাকতে বলি। কষ্টের প্রাপ্য হিসেবে সব অপমান এবং সব তিরস্কারকে মাথা পেতে না নিলে আমরা আবার তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হই। শরৎচন্দ ‘মহেশ’ গল্পে লিখেছিলেন- গ্রাম ছোট, জমিদার আরও ছোট, তবু তার দাপটে প্রজারা টুঁ শব্দটি করতে পারে না; এমনই প্রতাপ। সময়ান্তরে ক্ষমতাবান প্রত্যেকে একেকজন ‘ছোট জমিদার’ হয়ে উঠেছেন। দেশ স্বাধীন হলেও গফুর, আমিনারা যে ভালো নেই, তারা যে তীব্র অপমানের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তা জানিয়ে ভুপেন হাজারিকা খোলা চিঠি লিখেছিলেন শরৎবাবুর কাছে। এখন দশা তারও চেয়ে শোচনীয়। কৃষক তার সৃষ্টি ধ্বংস করে দেয় আগুনে পুড়িয়ে; কিন্তু আমাদের কোনো ভুপেন হাজারিকা নেই। দুঃখ জানানোর জন্য কোনো শরৎবাবুও নেই। জয়া ফারহানা : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক