স্মরণীয়-বরণীয় প্রয়াত আব্দুজ জহুর
হাসান হামিদ-
পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কী? সততা। কবি জন কিটস সেজন্যই বলেছেন, ‘Beauty is truth’ সত্যই সুন্দর। আর যিনি সেই সততার সৌন্দর্যকে ধারণ করেন, আমার বিবেচনায় তিনি জগতের সুন্দরতম ব্যাক্তি। ২০০৭ সালের ২২ মে আমাদের রাজনীতি অঙ্গনের এমন এক সত্যবালককে আমরা হারিয়েছি, যিনি দীর্ঘ বছর ক্ষমতায় থেকেও সততার প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন, তিনি সুনামগঞ্জের প্রয়াত শ্রদ্ধেয় আব্দুজ জহুর সাহেব। নিজের যতটুকু ছিল তা দিয়ে সব সময় দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। একজন সভাপতি হিসাবে তাঁর কোন কালিমা ছিল না, অবহেলা ছিল না দলের প্রতি বা দেশের প্রতি। সবাইকে নিয়ে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে সব সময় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন দেশ সেবায়।
আমি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাহেবের বাসায় গিয়েছি। আমার পরিচয় জেনে আমাকে স্নেহ দিয়ে একটা কথা উনি বার বার বলেছেন, “আব্দুজ জহুর সাহেব অনেক সৎ ছিলেন”। আমার গর্ব হয়েছিল তখন। আর ভাবছিলাম নানাসাব Professor Warren G. Bennis-এর সেই কথাটি বোধহয় লালন করেছিলেন আমৃত্যু, “Leaders are people who do the right thing; managers are people who do things right” নেতৃত্ব সম্পর্কে Dwight D. Eisenhower-এর একটি লেখায় পড়েছিলাম, “Leadership is the art of getting someone else to do something you want done because he wants to do it” আর নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রাম বাংলার মানুষের খুব কাছে থেকে তাদের সেবা, ন্যায্য দাবী পাইয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের খুব আপন হয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে সবার মধ্যমনি হয়ে এক বর্ণাঢ্য সেবকের জীবন অতিবাহিত করেছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জনাব আব্দুজ জহুর। ক্ষমতা পেয়েছেন অনেকবার, কিন্তু তা দ্বারা কখনো ক্ষমতাবান হয়ে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চিন্তা করেননি। খুব সাধারণ হয়ে অসাধারণ এক স্বচ্ছ রাজনৈতিক জীবন কাটিয়েছেন বর্ষীয়ান এই নেতা।
তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অশেষ ভুমিকা লক্ষ করা যায়, তিনি ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। মাতৃভাষার প্রতি টান থেকেই তিনি ছাত্রজীবনেই ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৫ সালে ৯২(ক) ধারা জারী হলে তিনি গ্রেফতার হন এবং কারান্তরালে যান। কিছুদিন কারাভোগ করে বের হয়ে এসে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৬৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি এই দলের সাথেই ছিলেন, সময়ে অসময়ে তিনি দলের জন্য, দেশের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, হাল ছাড়েননি।
১৯৭০ সালে তিনি সুনামগঞ্জ উত্তর এবং তাহিরপুর থেকে এমপিএ নির্বাচিত হন এবং ১৯৭১ সালে দেশে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সক্রিয় ভাবে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সফল সংগঠক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে তিনি একই আসন থেকে আবার দ্বিতীয়বারের মতো পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর সামরিক আদালতে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের হয় ও তিনি কারাগারে অন্তরীন হন। এ মামলা দুইটির মধ্যে বিচারে একটিতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন ও অন্যটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। একজন সৎ নির্ভীক নেতা হিসাবে আবার তিনি সবার মাঝে ফিরে আসেন এবং আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সাধারণ মানুষের হয়ে প্রতিবাদ করতে থাকেন। মানুষের ভালবাসা আস্থা অর্জন করতে থাকেন। সবার শ্রদ্ধাভাজন এই নির্লোভ ব্যক্তিটি ১৯৯১ সালে তৃতীয় বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সুনামগঞ্জের মানুষের কান্ডারী হয়ে কাজ করে তিনি আজও অমর হয়ে আছেন ।
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “To enjoy life, one should give up the lure of life” সত্যিকারের মানুষ এমনই হওয়া উচিত। আর সাধারণ মানুষের মাঝে থেকে উদার মানসিকতা নিয়ে জন-সাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে মহান হয়েছিলেন সুনামগঞ্জের সর্বস্তরের জনগণের প্রিয় নেতা সাদা মনের মানুষ প্রয়াত জনাব আব্দুজ জহুর এমপি সাহেব। সারা জীবন নিজের কথা, পরিবারের কথা না ভেবে শুধু দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন তিনি। আজকের এই দিনে মহান এ নেতার প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা জানাই। সবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর “সুপ্রভাত” কবিতার সেই লাইনগুলো, “নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই” (লেখক – গবেষক সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র)