হাওরবাসীর অনেকে এখন ঢাকার মজুর
সকালের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই বস্তির খুপড়ি থেকে বের হন তারা। কোদাল, ডালাসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাজারে আসেন। সেখানে জড়ো হন নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ ও যুবারা। কেউ করেন জোগালির (রাজমিস্ত্রির সহকারী) কাজ, কেউ মাটিকাটা, কেউ রাজমিস্ত্রি আবার কেউ কেউ বাসাবাড়ি পরিষ্কারের কাজ। আগে দৈনিক ২৫০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকায় মজুরি খাটলেও এখন তা কমে গেছে। অনেকে আবার কাজও পান না। হাওরের অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে এখন রাজধানীতে অবস্থান করছেন। বস্তিতে থাকা মানুষগুলোর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন প্রতিদিন ন্যূনতম একটি কাজ খুঁজে বের করা, যা দিয়ে চলবে তার জীবন-সংসার। প্রতিদিন আবার কাজও জোটে না। অর্ধাহারে-অনাহারে তাদের দিনাতিপাত। রোববার সকালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, বন্যাকবলিত হাওর অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন ঢাকার দিনমজুর। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সময় তারা কৃষিকাজ করতেন। তাদের কেউ কেউ ছোট গেরস্থ, কেউ মৎস্য আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু অকাল বন্যায় ধানখেত তলিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েন। তাই পেটের দায়ে ঢাকায় আসা। কিন্তু এখানে এসেও কাজ মিলছে না। ফলে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে তাদের।
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের কালাম মিয়া নিউমার্কেট এলাকায় কাজের খোঁজে অন্যদের মতো ভোর থেকে বসে ছিলেন। সকাল ৯টা বাজলেও তাকে কেউ কাজে নেয়নি। তিনি জানান, কৃষিকাজ ও মাছ ধরা ছাড়া কোনো কাজ না জানায় কেউ তাকে নিচ্ছে না। তিনি জানান, অকাল বন্যায় তার এলাকার সব তলিয়ে গেছে। মাছও মরে গেছে। তাই পেটের দায়ে চারদিন আগে রাজধানী ঢাকায় আসা। দুদিন ইট টানার কাজ পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর কাজ মিলছে না। তার সঙ্গে ইটনা, মিঠামইন এলাকার অর্ধশতাধিক লোকও ঢাকায় এসেছে। তারাও তেমন কাজ পাচ্ছে না।
সুনামগঞ্জ থেকে আসা মজিবর বলেন, ‘কাজের চেয়ে লোক বেশি হওয়ায় মজুরি কমে গেছে।’ মহাখালীতে কথা হয় ভোলার ৫৫ বছর বয়সী মো. কাঞ্চন মিয়ার সঙ্গে। রাজমিস্ত্রির হেলপার হিসেবে কাজ করেন তিনি। ১০ বছর ধরে ঢাকায় আছেন। রাজধানীর গুদারাঘাট বস্তিতে পরিবার নিয়ে কোনোমতে দিন পার করেন। তিনি বলেন, ‘কারও কাছে হাত পাতলে দুই টাকা পামু। তবে ভিক্ষা না কইরা কষ্ট কইরা খাইতে চাই। হেইডাও পাই না। প্রতিদিন জীবনের লগে যুদ্ধ কইরা চলতে হয়।’ ‘পেটের দায়ে কাজের লাইগা রাস্তায় বসি। পুলিশ আমাগো লাঠিপেটা কইরা তুইলা দেয়। কই যামু আমরা, কই গ্যালে আমাগো বাপ-মা, বউ-পোলাপানের ক্ষুদা মিটাইতে পারমু’- এমন প্রশ্ন তুলে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন এ দিনমজুর।
কুমিল্লা থেকে আসা শ্রমজীবী গফুর আলী জানান, সকাল থেকে বসে আছি, কাজ নেই। এক মুঠো চাল কেনার উপায় নিই। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে অনাহারেই দিন কাটে তার। তিনি আরও জানান, সপ্তাহে তিন-চারদিন কাজ জুটলেও তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই আল্লাহর ওপর নির্ভর থাকতে হয়। একমাত্র তিনিই চালিয়ে নেন।