হাওরবাসীর আন্দোলনের নানা খবর
তলিয়ে গেছে সাংহাইর হাওর, কৃষকদের আর্তনাদ
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ৫টি হাওরই বৃষ্টির পানি ও বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে গেছে। শনিবার (০৮ এপ্রিল) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- উপজেলার দেখার হাওর, কাই হাওর, জামকলা হাওর, কাঁচি ভাঙ্গা হাওর তলিয়ে গেছে আরো আগেই। অবশেষে সাংহাইর হাওরও পানিতে তলিয়ে গেল। এতে আর্তনাদ করছেন কৃষকরা। তাদের প্রশ্ন- ‘আমরা এখন কার কাছে যাব?’ এ বছর উপজেলার ১৩ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এই জমির ধান পাওয়া গেলে বাজারমূল্য হত প্রায় ৯০ কোটি। সব হারিয়ে কৃষকরা এখন পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। তারা বলছেন- “কে আমাদেরকে সাহায্য করবে। ঠিকাদার তো বাঁধের টাকা মেরে-খেয়ে এখন বিল্ডিংয়ে ঘুমাচ্ছে। আমাদের কেউ দেখার নাই। কার কাছে যাব আমরা?” ধান হারিয়ে কৃষকরা হতবাক হয়ে পড়েছেন।
দেখার হাওরে ধান চাষ করা কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন- আমি এ বছর ২০ কেয়ার জমিতে ধান চাষ করেছি। কিন্তু পানি এসে আমার সব ধান নিয়ে গেছে। ধান যখন চারা বের হবে তখনই বাঁধ ভেঙে পানি আসে। এ বছর একটি ধানও পাব না। চাল কিনে খেতে হবে। আগামী এক বছর কীভাবে যে সংসার চালাব, তা নিয়ে দুশচিন্তার মধ্যে আছি। সব কৃষককেরই তো এক ধরনের অবস্থা।
সাংহাই হাওরে জমি চাষ করা বর্গাচাষী সঞ্জব আলী, আমিরুল ইসলামসহ অনেক কৃষকই বলেন-“ ধান যাওয়ার কথা কী আর বলব। নিজের চোখেই তো সব দেখতে পাচ্ছেন, আমার সব শেষ। আমরা অন্যের জমি চাষ করি। এ বছর অনেক আশা নিয়ে মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বীজ ও সার ক্রয় করে জমি করেছি। কে জানে যে এই চৈত্র মাসে বৃষ্টি হবে আর বাঁধ ভেঙে আমাদের এতো বড় সর্বনাশ হবে! আমরা আপনাদের মাধ্যমে সরকারকে একটি কথা বলব- সরকার যেন আমাদরেকে সাহায্য করে, না-হলে আমরা কৃষকরা না-খেয়ে মারা যাব এবং যারা বাঁধের কাজে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানাই।” এদিকে, পিআইসি ও ঠিকাদারদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে কৃষক নেতারা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা যায়। এ কারণে ০৩ এপ্রিল সোমবার ও ০৫ এপ্রিল বুধবার সিলেট-সুনামগঞ্জ- মহাসড়ক অবরোধ করেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার সাধারণ কৃষকরা।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন- দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার হেক্টর জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। আর যেগুলো জমিতে বৃষ্টির পানির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সেই জমিরও ধান গাছের গোড়ায় পচন ধরে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি ও বাঁধ ভাঙার কারণে কৃষক এ বছর ধান পাবে না বললেই চলে।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’র মানববন্ধন
দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ বাজার ও পাগলা বাজারে পৃথকভাবে “হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন” সুনামগঞ্জের উদ্যোগে পথসভা ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার বিকাল ৪টায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন শান্তিগঞ্জ বাজার পয়েন্ট এলাকায় “হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন” সফল ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পথসভা ও মানবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট লেখক ও প্রভাষক এনামুল কবিরের সভাপতিত্বে ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী জমিরুল ইসলাম মমতাজের সঞ্চালনায় মানববন্ধন পরবর্তী পথসভায় বক্তব্য রাখেন- “হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন” এর সিনিয়র যুগ্ন আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, সদস্য সচিব বিশিষ্ট সাংবাদিক বিন্দু তালুকদার, অন্যতম সদস্য জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. এনাম আহমদ, সাংবাদিক এমরানুল হক চৌধুরী, নাঠ্যকর্মী সমীর পল্লব, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক এম এ কাসেম, সাংগঠনিক সম্পাদক ও দৈনিক সুনামকণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার হোসাইন আহমদ, দৈনিক সুনামগঞ্জ খবের ষ্টাফ রিপোর্টার শহীদ নুর আহমদ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা যুবদলীগের সহ সভাপতি রাজা মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান সুজন প্রমুখ। সভায় বক্তারা কৃষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্ঘত এলাকা ঘোষনার দাবী জানান। পাশাপাশি সুনামগঞ্জে দূর্নীতিবাজ পাউবো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আগামী ১৩ ই এপ্রিলে সুনামগঞ্জের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সকলের সহযোগিতা এবং স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ কামনা করেন।
জামালগঞ্জ দুর্গত এলাকা ঘোষনার দাবিতে মানববন্ধন
জামালগঞ্জ উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবীতে কৃষক-জনতা ও সর্বস্থরের জনগণের মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (১০ এপ্রিল) দুপুরে উপজেলার সামাজিক সংগঠন আল হক্কুল আমিন পরিষদের ব্যানারে উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন প্রধান সড়কে সংগঠনের সভাপতি মুহা. আলতাফুর রহমান সভাপতিত্বে মানব বন্ধনে বক্তরা দাবী জানিয়ে বলেন, সরকারের কাছে সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবী জানান। তারা দাবি করেন হাওরের ত্রুটি পূর্ণ বাঁধনির্মানের ফলে বছরের একটি মাত্র ফসল তলিয়ে যাওয়ায় এলাকার হাজার হাজার মানুষের চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে।
পাউবোর দুনীতিবাজ কর্মকর্তা, পিআইসি কমিটি ও ঠিকাদারদের বিচারের দাবীও জানানো হয়। এছাড়া চাল, আটা, ময়দাসহ নিত্য পণ্যের মুল্য নিয়ন্ত্রনে রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া, সরকারী বেসরকারী ঋন মওকুফ করা, সুদমুক্ত নতুন ঋন প্রদানসহ ১৩ দফা দাবীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রসূন কুমার চক্রবর্তীর নিকট স্মারক লিপি প্রদান করেন।
মানব বন্ধনে অংশ নেন, সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ সদস্য আলহাজ¦ আব্দুল মুকিত চৌধুরী, ফেনারবাঁক ইউপি চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু তালুকদার, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মতিউর রহমান, জহিরুল হক তালুকদার, তরুণ সমাজ কর্মী জুলফিকার চৌধুরী রানা, সদর ইউপি বিএনপি চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল মতিন, মতিউর রহমান মতি, প্রেসক্লাব সভাপতি অঞ্জন পুরকায়স্থ ও সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, আখতারুজ্জামান তালুকদার, মাওঃ আজহারুল ইসলাম, কাজী রশিদ আহম্মদ, মাওঃ মফিজুর রহমান আলাল, মাও: দিলোয়ার হুসেন, মাও: রাসেল আহম্মদ, মাও: রায়হান আহমেদ, আব্দুর মোছাব্বির, আবুল কালাম জাকারিয়া, রিয়াজ উদ্দিন, জিতেন্দ্র তালুকদার পিন্টু, শ্রমিকনেতা মুহাম্মদ আলী, হাফিজ এহ্সানুল হক, হাফিজ আল হাসান, ক্বারী আলীম উদ্দিন, মোর্শারফ হোসেন সহ কয়েক হাজার কৃষক।
দিরাইয়ে হাওর রক্ষা বাঁধের স্থায়ী সমাধান ও দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে মানববন্ধন
দিরাইয়ে হাওর রক্ষাবাধের স্থায়ী সমাধান ও উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষনার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে জাগো দিরাই নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। রবিবার (০৯ এপ্রিল) থানা পয়েন্টে সংগঠনের সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং মুসলেহ উদ্দিনের অনুষ্ঠিত ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন, জয়নাল আবেদিন, সামছুল ইসলাম চৌধুরী শাহীন, শাহীন আলম রুবেল, শাহ আলম, জুনায়েদ মিয়া,সুমন মিয়া, রুকনুজ্জামান জুহুরী প্রমুখ। মানববন্ধনে বক্তব্যকালে বক্তারা বলেন,অকালে হাওরের ফসল ডুবির ঘটনা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় মানব সৃষ্ট দুর্যোগই দায়ী। বাঁধ নির্মানে সংশ্লিষ্ট পাউবো,পিআইসি ও টিকাদাররা পকেটভারী করতে বাধের নামে ফাদ তৈরী করছেন, যেখানে সামান্য টাকায় বাধকে স্থায়ী করা যায় সেখানে বাধের গুড়ায় বিশাল গর্ত করে বাধের নামে প্রতিবছর বরাদ্ধের টাকা লুটপাট চালিয়ে আসছেন।
একটি সিন্ডিকেট বাধ এলাকায় স্লুইস গেইটকে চক্রান্ত করে অকেজো করে প্রতিবছর বাধের নামে একটি চক্র বাণিজ্য করছেন। স্লুইস গেইটকে সচল করে যথাযথভাবে হাওরের পানি নিস্কাশনের উপযোগী করে তুলতে হবে। নদী খনন করে পাউবো’র বাধ নামের ফাদকে স্থায়ীভাবে বাধার দাবী জানান তারা।
অকালে ফসল হারিয়ে কৃষকরা নানামুখী সংকটে পড়েছেন, একদিকে গো-খাদ্যের সংকটে কুষকরা হালের গরু বিক্রি করছেন,অপরদিকে জীবন জীবীকা নিয়ে পড়ছেন মহা সংকটে, তাই এ অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষনা কওে কৃষকদের বাচাতে সকল সহযোগীতা বাড়াতে সরকারের প্রতি দাবী জানান। কৃষকবাচাতে মানববন্ধন নয় আগামীতে আন্দোলনের ডাক দেয়ার হবে।
সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গত ঘোষণার দাবিতে সুজন’র মানববন্ধন
হাওরের বোরো ফসলডুবির ঘটনায় বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির সাথে জড়িত পিআইসি, ঠিকাদার ও পাউবো কর্মকর্তাদের শাস্তি এবং সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার (১০ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১১টায় স্থানীয় আলফাত স্কায়ারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সুনামগঞ্জের আয়োজনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সুজন সুনামগঞ্জের সভাপতি অ্যাড. হোসেন তৌফিক চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দরের উপস্থাপনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন- হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক বিজন সেন রায়, নাট্যশিল্পী জাহাঙ্গীর আলম, কৃষক নেতা আব্দুল কাইয়ুম, শিক্ষক মো উস্তার আলী প্রমুখ।
বক্তারা বলেন- সুনামগঞ্জে এ বছর ২ লক্ষ ২৩ হাজার ৮৫ হেক্টর জমিতে বোরো ফসল আবাদ হয়েছিল। এই ফসল ঘরে তুলতে পারলে কৃষকদের কোন দুচিন্তা থাকত না। মানুষ যখন ফসল ঘরে তুলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে সব ভেসে গেছে। এর মধ্যে ৪৮ কোটি টাকার কাজই ঠিকাদারদের। বাঁধের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। ফসল রক্ষা নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঠিকাদার ও পিআইসির লোকজন লাখ লাখ কৃষকের সঙ্গে তামাশা করেছে। পরিশেষে কৃষকদের রেশনিং কার্ড চালু, খোলা বাজারে চাল ও আটা বিক্রির ব্যবস্থাসহ কৃষিখণ মওকুফ করার জোর দাবি জানান।