হাওরবাসীর হতাশার বাজেট!
২০১৯-২০ অর্থবছরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন খাতে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বাজেটের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই খাতে গত বছর বাজেট বরাদ্দ ছিল ৮৮৪ কোটি টাকা, এ বছর তা দ্বিগুণ করে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাজেটে বলা হয়েছে- ২০১৯-২০ অর্থবছরে গবেষণার মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট চারটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর, এফফএমডি ও পিপিআর রোগ দমনে কার্যকর মডেলের সম্প্রসারণ, প্রাণী খাদ্য সংরক্ষণে ডোল পদ্ধতির সম্প্রসারণ, বিভিন্ন বিষয়ে ৩৫টি গবেষণা বাস্তবায়ন, তিনটি আঞ্চলিক কেন্দ্রে ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের কর্ম পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ হাওরের প্রাণী ও মৎস সম্পদ উন্নয়নের জন্য বাজেটে কোন বিষয় উপস্থাপনা করা হয়নি। হাওরবাসীদের দাবি, গেল দুই বছর হাওরের কৃষকরা একটি জমির ধানও সঠিকভাবে ঘরে তুলতে পারেনি। অকাল ব্যনায় বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল পানির নিচে তলিয়ে যায়। তাই হাওর এলাকায় অকাল বন্যা রোধে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন ছিলো। বিশেষ করে ‘হাওরবাসীর সার্বিক উন্নয়ন’ শিরোনামে একটি বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন ছিলো। যেখান থেকে হাওরের সব ধরণের সমস্যার ক্ষেত্রে অর্থ ব্যায় করা হবে।
বিশেষ করে হাওরবাসীর সব চেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে বাধ নির্মাণ। হাওরের এই বাধের কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ কৃষকদের পথে বসতে হয়। সেই বাধগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মাণের জন্য আদালা বরাদ্দের প্রয়োজন ছিলো। কৃষকদের মতে, হাওর সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া। বছরের পর বছর পলি জমে হাওর এলাকার নদীগুলোর নাব্যতা ও পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। তাই পাহাড়ি ঢলে সামান্য পানি এলেই বাঁধ ভেঙে বা উপচে তা হাওরে প্রবেশ করে। হাওর সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে নদী খননের কোনো বিকল্প নেই। তাই বাজেটে হাওর এলাকার নদীগুলো খননের জন্য বড় ধরনের বরাদ্দ আশা করেছিলেন হাওরবাসী। কিন্তু সেখানেও হতাশ হতে হয়েছে তাদের। এদিকে, বিস্তীর্ণ হাওরজুড়ে এখনও তেমন স্থলপথ সৃষ্টি হয়নি। ফলে যাতায়াত দুরবস্থার কারণে বোরো ধান তুলতে ভোগান্তির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কৃষকরা। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার।
জানা যায়, হাওর অঞ্চলের একটি জেলা শুধুমাত্র হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচশ’র অধিক হাওর রয়েছে। কোনো কোনো হাওরের দূরত্ব গ্রাম থেকে প্রায় ২০/২৫ কিলোমিটার। এসব হাওরে চাষাবাদ করতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় কৃষকদের। হাওরে যাতায়াতের রাস্তা না থাকায় জমির আল দিয়ে ২০/২৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে চাষাবাদ করতে যেতে হয়। সেই সঙ্গে কৃষি সামগ্রীও নিতে হয় মাথায় অথবা কাঁধে করে। এতে সময় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত শ্রমিক খাটাতে হচ্ছে। বিশেষ করে বৈশাখ মাসে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হয় কৃষকদের। এ সময় বোরো ধান ঘরে তুলেন হাওরের কৃষকরা। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে হাওর পাড়ের কৃষকদের। সেই সাথে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কৃষকরা, বাড়ছে শ্রমিক সংকট। হাওরবাসীর প্রত্যাশা ছিলো- এ বিষয়টি মাথায় রেখে এবারের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। একই সাথে কৃষকরা যেন ধানের ন্যায্যমূল্য পায় সেজন্য সরকার থেকে ধানের মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাবনা করা হবে বাজেটে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সদস্য এমদাদুল হোসেন খান বলেন- ‘কৃষিবান্ধব এই সরকারের প্রতি হাওরবাসীর অনেক প্রত্যাশা ছিলো। কিন্তু বাজেট নিয়ে এখন হাওরের জনগোষ্ঠির হতাশা ছাড়া কিছুই নেই।’
তিনি বলেন- ‘হাওর পাড়ের মানুষের জীবন খুবই দুঃখের। কোন ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই তাদের ছেড়ে যায় না। তাই হাওরের জনগোষ্ঠির কথা বিবেচনা করে হাওর উন্নয়ন নামে বাজেটে একটি বরাদ্দ রাখা উচিত ছিলো।’ এ ব্যাপারে সাহিত্য পত্রিকা ‘তরঙ্গ’র সম্পাদক শিব্বির আহমেদ আরজু বলেন- ‘হাওরবাসীর দীর্ঘদিনর দাবি ছিল ‘হাওর উন্নয়ন’ নমে একটি বিশেষ বরাদ্দ রাখার। এর জন্য অনেক দাবিও করা হয়েছিলো। কিন্তু বাজেটে এরকম কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। যা সত্যি হাওরবাসীর জন্য দুঃখের বিষয়।’ তিনি বলেন- ‘সারাদেশের খ্যদ্যের সব চেয়ে বড় যোগান দেয় হাওর। আর সেই হাওরকে বাদ দিয়ে কোন উন্নয়ন করলে সেই উন্নয়ন ঠেকসই হবে না।’ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল। তিনি বলেন- ‘মানুষের যে মৌলিক অধিকারগুলো রয়েছে তাও হাওরবাসী পান না। শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য সবগুলো বিষয় থেকেই হাওর অঞ্চলের জনগোষ্ঠি পিছিয়ে রয়েছে। প্রতি বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে হাওরে কান্নার রোল পড়ে। তাই অবহেলিত এই হাওরবাসীর কষ্টের বিষয়টি বিবেচনা করে বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন ছিলো।’ তিনি বলেন- ‘হাওরকে বাদ দিয়ে যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়। সেই বাজেট সফল হতে পারে না। কারণ মোট কথা এটাই যে হাওর অঞ্চলকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।’