লেখক : আলমগীর শাহরিয়ার–

হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বরষায় বিশাল, বিস্তীর্ণ জলরাশির এক সীমাহীন প্রান্তরের ছবি । সেই জলরাশির বিচিত্র রূপ। কখনো নিপাট, নীরব নৈঃশব্দে ভরা সূর্যাস্তের সোনালী আভার রঙে ঢেউ খেলে যাওয়া, কখনো রুদ্র-রোষে জেগে ওঠা আফালের(ঢেউয়ের) শুধু বিরামহীন হুঙ্কার । আছে অবিরাম সোনালি সবুজ ফসলের হাতছানি । বিশ্বব্যাপী যখন জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আজ বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে ঠিক সে মুহূর্তে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও অগণিত সমস্যার আবর্তে নিপতিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাওর নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা ও গবেষণা খুবই সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক । অবহেলিত জনপদ  হাওর নিয়ে তথ্য উপাত্ত ও গবেষণা খুবই অপ্রতুল; নেই বললেই চলে । ধারাবাহিক এ লেখাটি হাওরের সমস্যা, সম্ভাবনা ও আশু করণীয় জানার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র ।

টিপাইমুখ বাঁধ ও হাওরের ভবিষ্যৎ
আগ্রাসী উন্নয়ন প্রতিযোগিতার দৌড়ে অগ্রসর রাষ্ট্র ভারত তার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া জ্বালানী ও বিদ্যুৎ ক্ষুধা মেটানোর জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মতামত ও স্বার্থকে কোনোরূপ তোয়াক্কা না করেই ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় নদী বরাকের উপর একতরফাভাবে বাঁধ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের বরাক ওপর নির্মিতব্য এ বাঁধটি টিপাইমুখ নামের গ্রামে বরাক এবং টুইভাই নদীর মিলনস্থল। এই মিলনস্থলের ১ হাজার ৬০০ ফুট দূরে বরাক নদীতে ৫০০ ফুট উঁচু ও ১ হাজার ৬০০ ফুট দীর্ঘ বাঁধ । যা বৃহত্তর সিলেটসহ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের পরিণতি হবে ভয়াবহ। উল্লেখ্য, বরাক বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে সুরমা ও কুশিয়ারা দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে এবং হাওরের জলের প্রধান উৎস হিসেবে পরিচিত।

পানি ও পরিবেশ ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান ও প্রকৌশলী ম. ইনামুল টিপাইমুখে বাঁধকে সিলেট বিভাগের জেলাগুলোর জন্য বিপদ সংকেত হিসেবে দেখছেন। কেননা, সুরমা ও কুশিয়ারা নদী দুটি সিলেট বিভাগের হাওরগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত এবং বর্ষায় হাওরগুলোকে জলপূর্ণ করে রাখে, শীতে নিষ্কাশন করে। টিপাইমুখ ড্যাম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এবং হেমন্ত, শীত ও বসন্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত নদীতে পানি ছাড়বে। এর ফলে হাওর এলাকায় এক ফসলি জমিগুলো ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত পানিতে ডুবে থেকে জাগতে পারবে না ও বোরো ধান লাগানো যাবে না। এর ফলে প্রতিবছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি ধান থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।

একটি জাতীয় দৈনিক তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারত গোয়াইনঘাট উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত সারি নদীর উজানে ইতোমধ্যে গোপন আরেকটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত এসব এলাকায় বাঁধ নির্মাণ আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। বড় ধরণের ভূমিকম্পের আশঙ্কা ছাড়াও বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যে ক্ষতি হবে তার মারাত্মক ও সুদূরপ্রবাসী প্রভাব পড়বে মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার উপর। হাওরাঞ্চল হবে যার সবচেয়ে বড় শিকার।

হাওর রক্ষায় করণীয়:
২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ সালে ইরানের রামসার শহরে Convention on Wetlands of Int’l Important Especially as Waterfowl Habitat, 1972 সম্মেলনে পৃথিবীর জলাভূমি বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি হয়। রামসার এবং আন্তর্জাতিক প্রাণ বৈচিত্র্য সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। উল্লেখ্য, এতে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ স্বাক্ষর ও অনুমোদন রয়েছে। যা টিপাইমুখ প্রসঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে কার্যকরী করা যায়। আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র সনদের (Convention on Biological Diversity) CBD,1992 ১৪নং অনুচ্ছেদের ‘ঘ’ ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে, ‘চুক্তিবদ্ধ পক্ষরাষ্ট্রের আওতাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সৃষ্ট কোনো কারণে যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রাণ বৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে তবে সম্ভাব্য ক্ষতির শিকার সে রাষ্ট্রকে তা অবিহিত করতে হবে এবং ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে’।

এছাড়াও রামসার সনদের ৫নং অনুচ্ছেদ উল্লেখ আছে, চুক্তিবদ্ধ পক্ষ রাষ্ট্রসমূহ রামসার সম্মেলন থেকে উদ্ভূত দায়-দায়িত্ব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যা একাধিক রাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমানা জুড়ো বিস্তৃত এবং যেসব জলপ্রণালী এক বা একাধিক রাষ্ট্র ব্যবহার করে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রগুলো জলাভূমি এবং জলাভূমির উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল সংরক্ষণের জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধান বাস্তবায়ন করবে।

আন্তর্জাতিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় এসব চুক্তি ও সনদের গুরুত্ব উপেক্ষা করে যদি আগ্রাসী মনোভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র সুরমা উপত্যকার মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে উদ্যত হয় তবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা, সীমান্তের দু’পাশের মানুষের সম্ভাব্য ভয়াবহ ক্ষতির প্রভাব নিয়ে খোলা মনে সমাধানের লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে এমন বৈরী স্বার্থান্বেষী অপতৎপরতা রুখতে হবে । উল্লেখ্য, সীমান্তের ওপারে বরাক উপত্যকার মানুষও এই বাঁধে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ চিন্তা করে উদ্বিগ্ন । বাঁধের বিরুদ্ধে তারাও প্রতিবাদ করছে ।

এছাড়াও হাওর রক্ষায় অবশ্য করণীয় সিদ্ধান্ত এবং সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
*  হাওর এলাকায় প্রাণ প্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত নদী ও খাল খনন করা;
* বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় মানুষের সম্মিলিত পরামর্শে নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন ও প্রয়োজনমাফিক উঁচু করতে হবে;
*  মিঠা পানির মৎস্য সম্পদ ( অনেক বিলুপ্ত প্রায় মাছ ও জলজ সম্পদ) রক্ষার্থে হাওরে বিলগুলোর সরকারি ইজারা পদ্ধতি সংস্কার করতে হবে;
* পানি উন্নয়ন বোর্ড এর অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দুর্নীতির মহোৎসব, গাফিলতি ও উদাসীনতা বন্ধ করতে হবে; নজরদারী বাড়াতে হবে,
* হাওর এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি ও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বাড়াতে হবে;
*একমাত্র নির্ভরশীল ফসল ধান চাষের বাইরে বিকল্প কৃষি অর্থনীতি ও নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে,
* হাওর ও বিল সংলগ্ন এলাকায় খাস জায়গা বরাদ্দ বন্ধ করে সরকারিভাবে স্থানীয় জলজ উদ্ভিদ ও বৃক্ষের সমারোহে সবুজায়নের উদ্যোগ নেয়া দরকার, কেননা ফসলের বাইরেও হাওরাঞ্চলে প্রাণ ও প্রকৃতির একটা বিশাল জগত আজ বিপন্নপ্রায়,
* অবিলম্বে হাওর উন্নয়ন বোর্ড সক্রিয় করতে হবে, প্রয়োজনে হাওর উন্নয়নে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে । যেখানে হাওরের মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের যোগ্য নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ থাকবে।

হাওর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে এদেশের সবচেয়ে অবহেলিত জনপদের নাম। একমাত্র ফসল বোরো ধানের উপর নির্ভর করে কৃষকের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়াসহ সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। তারপরও আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে হাওরের মানুষের সংগ্রামী জীবন। হাওরের সমুদ্র সদৃশ ঢেউ / আফালের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে বেঁচে আছে কৃষক আর জন্ম দিয়েছে অনুপম সমৃদ্ধ সংস্কৃতির । ঝড়-ঝঞ্জায় বিক্ষুব্ধ মানুষ সোনালী ফসলের স্বপ্নে কাটিয়ে দেয় তার দুঃসহ প্রহর। সেই সোনালী ফসলের বিরুদ্ধে প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট যেকোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে দাড়াতে হবে কৃষককেই। কেননা ভরা ফসলের প্রান্তর কৃষকের আরাধ্য ভূমি। নতুন প্রজন্মের মসৃণ, সুন্দর আগামী বিনির্মাণে তাদের ক্লান্ত শ্বাস আর স্বেদ-ভেজা মাটিতে ফসল বোনার স্বপ্নই কৃষকের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন । কবির সংবেদনশীল মন জেনেছে কৃষকের কান্না আর অন্তরের দহন ।

তাই কি অবলীলায় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেন,

‘ভরা ফসলের মাঠে যদি মৃত্যু হয় তবু দুঃখ নেই
সূর্য ওঠার আগেই যদি মৃত্যু হয় তবু কোনো দুঃখ নেই,
জেনে যাবো, ভোর হবে-আমাদের সন্তানেরা পাবে মুগ্ধ আলো,
শীতার্ত আধারে আর পুষ্টিহীন শিশুদের কান্নার বিষাদ
কোনদিন শুনবে না কেউ।
জেনে যাবো ঋণমুক্ত আমাদের কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী এলো।
ভরা ফসলের প্রান্তরে যতি মৃত্যু হয় তবে আর দুঃখ কিসে!
জেনে যাবো শেষ হলো বেদনার দিন-ফসল ফলেছে মাঠে,
আমাদের রক্তে শ্রমে পুষ্ট হয়েছে এই শস্যের প্রতিটি সবুজ কণা।’
(ফসলের কাফন, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ)

তথ্যসূত্র
১। Beck, Ulrich; The Modernity and Risk Society (article)
২। Giddens, Anthony; Sociology, Polity Press, Cambridge, 2006
৩। www.wikipedia. com
৪। আলী, সৈয়দ মুর্তজা; হজরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস, উৎস প্রকাশন, ঢাকা।
৫। আলী, আবু সাজ্জাদ হোসাইন; সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
৬। ইউনুছ, আলী; হাওরবাসীর জীবন কথা; চারুলিপি,ঢাকা।
৭। দাশ, সুমন কুমার; টাঙ্গুয়ামঙ্গল, উৎস প্রকাশন, ঢাকা।
৮। সিদ্দিক, মোঃ জাফর; টাঙ্গুয়ার হাওর, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন
৯। শহিদুল্লাহ, রুদ্র মুহম্মদ; শ্রেষ্ঠ কবিতা, বিদ্যা প্রকাশ, ১৯৯৪।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn