কাসমির রেজা-

হাওরে একবারই ফসল হয়। সেই ফসলেই চলে আমাদের বছরের সংসারের খরচ, সন্তানের শিক্ষা সবকিছু। এবার আমার সব ফসল শেষ। ঢাকায় পড়া ছেলেটা কাল আমার কাছে এসে জড়ায়া ধইর‍্যা বলল, আব্বা আমার কি পড়ালেখা হবে না? তুমি খরচ দিবা ক্যামনে?’ কথাগুলো বলতে বলতে ৫০ ছুঁই ছুঁই সুঠাম দেহের কৃষক শফিকুল হকের গলা কান্নায় ধরে এল। সুনামগঞ্জের শনির হাওর থেকে এসেছেন তিনি। এ বছরটা কেমন করে চলবে, সেই ভাবনা তাঁর। তাঁর কথা, এবার যে ক্ষতি হলো, তা পূরণ হবে না। তবে যাদের অবহেলায় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে যে ফসলহানি হলো, তাদের চিহ্নিত করা হোক। তিনি বললেন, ‘যাদের কারণে হাওর ডুবল, তাদের শাস্তি চাই।’ শফিকুলের সঙ্গে থাকা ওই অঞ্চলের কৃষকদের মুখে এই কথারই প্রতিধ্বনি। শুধু এসব স্থানীয় ভুক্তভোগীই নন, ভূমি ও পানি অধিকার এবং মানবাধিকারকর্মীরাও বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং তাদের শাস্তিতে হলেন সোচ্চার। বুধবার রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওরের ফসল ও জনজীবন : সরকার ও জনগণের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই দাবি উঠল। ভূমি অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

গোলটেবিলের সভাপতি মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বললেন, সরকারি দপ্তরগুলোর পরিকল্পনাহীনতা ও সমন্বয়হীনতার কারণেই এবারে হাওরের বিপর্যয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিকারের জবাবদিহি রয়েছে, স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে, তাদের বাঁধ নির্মাণসহ কোনো কাজে রাখা হয়নি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তাঁরা নিজেদের লাভ দেখেন। তাঁদের লাভ এবং লাভের শিকার হলো সাধারণ মানুষ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে দুর্বৃত্তরা বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যায়। হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দায়ী প্রতিষ্ঠান এবং ঠিকাদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এমন বিপর্যয় আবারও দেখা দেবে। অনুষ্ঠানে ওয়ারপোর সাবেক মহাপরিচালক ম. ইনামুল হক বলেন, হাওরে ফসল রক্ষায় যে বাঁধ নির্মিত হয়, পানির গড় উচ্চতা এর চেয়ে বেশি হয়। এখানে অনেক ক্ষেত্রে বাঁধ উঁচু করতে হবে। সেখানে ফসল যেন আগাম উঠে আসে, সে লক্ষ্যেও পরিকল্পনা নিতে হবে। গত ১৭ বছরে হাওরে আটটি বড় ধরনের বন্যা হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে বেলার প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান বলেন, তাই এ অঞ্চলকে বিশেষভাবে নাজুক অঞ্চল ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে। এবারের আগাম বন্যায় মানুষের দুর্গতির কারণে হাওরে ক্ষুদ্রঋণ মওকুফ করে দেওয়ার যে দাবি স্থানীয় মানুষ করেছে, তা যৌক্তিক বলেও মত দেন আইনবিদ রিজওয়ানা হাসান।’

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা। সময় মতো বাঁধ নির্মাণ না হওয়া, নদীভরাট, আর্থিক দুর্নীতিকে তিনি হাওরে ফসলহানির কারণ বলে চিহ্নিত করেন। হাওরের ৯০ ভাগ পরিবাররে মধ্যে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির দাবি করেন তিনি। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, প্রতিষ্ঠানের উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান,পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পিযুষ রঞ্জন পুরকায়স্থ টিটু, সালেহীন চৌধুরী শুভ, নির্মল ভট্টাচার্য, শনির হাওর পারের কৃষক শাহীন রেজা, শফিকুল ইসলাম, আব্দুস সুবহান প্রমুখ।

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn