১৪ বছরেও বিচার হয়নি কিবরিয়াসহ ৫ হত্যাকাণ্ডের
জানা যায়, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন হবিগঞ্জ-৩ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। হামলায় আরও নিহত হন কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী। আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী। ঘটনার দিন রাতেই হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এমপি বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তে নামে পুলিশসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। সিআইডি’র তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ প্রথম অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন। অভিযোগপত্র দেওয়ার পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করেন। এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ছয় বছর পর নতুন এ প্রতিবেদনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামের প্রধান মুফতি হান্নানসহ মোট ২৪ জনের নাম উঠে আসে। ২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশিটের ওপর হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের না-রাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ৯ বছর পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। চার্জশিটে নতুন ১১ জনসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন—সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া। একইসঙ্গে পূর্বের চার্জশিটভুক্ত ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আব্দুল করিম ও মরহুম আহছান উল্লাহকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়।এর পর ২০১৫ সালের জুনে মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। এর পর থেকে সেখানে বিচার কার্যক্রম চলছে। এখন চলছে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্ব। মোট আসামি ৩২ জনের মধ্যে অন্য একটি মামলায় ৩ আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। জামিনে আছে ১২ জন, পলাতক ৭ জন ও হাজতে ১০ রয়েছে জন।
শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘বর্তমান যে মামলা চলছে তার ওপর আমাদের কোনও ভরসা নেই। এখনও পর্যন্ত এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি।’ নিহত আবুল হোসেনের স্ত্রী আছিয়া খাতুন জানান, এই হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর হয়েছে, এখনও বিচার হয়নি। তবে আমরা বিচারের আশায় আছি। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করছি। কেউ খোঁজ খবর নেয় না। কথা ছিল আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করা হবে কিন্তু কেউই করেনি। আমরা চাই, দ্রুত কিবরিয়াসহ পাঁচ হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হোক। নিহত সিদ্দিক আলীর ছেলে কুদ্দুছ মিয়া জানান, আমার বাবাসহ কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর অতিক্রম হয়েছে কিন্তু আমরা বিচারের মুখ দেখতে পেলাম না। অনেক কষ্ট করে সংসার করতে হচ্ছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার। এ সরকারের আমলে আমার বাবার বিচার না হলে বিচার হবে কি না সে ব্যাপারে আমরা সন্দেহ প্রকাশ করছি। তাই এই সরকারের আমলেই বিচার দেখতে চাই। আহত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ সর্দার জানান, এখনও শরীরে গ্রেনেডের পিন্টারে যন্ত্রণা করে। অসংখ্য প্রিন্টার শরীরে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমার মৃত্যু হয়েছে শুনে আমার বাবা মারা যান কিন্তু ১৪ বছরে বিচার না হওয়ায় আমি হতাশ। বর্তমান সরকারের আমলে বিচার দেখতে চাই। আল্লাহর অশেষ দয়ায় ও শেখ হাসিনার সহযোগিতায় আজও আমি টিকে আছি।’
মামলার বাদী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ খান বলেন, ‘আইনি জঠিলতার কারণে মামলার বিচার শেষ হতে বিলম্ব হচ্ছে। এ দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। তাই আশাবাদী, কিছুটা বিলম্ব হলেও বর্তমান সরকারে আমলেই কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে।’ গ্রেনেড হামলায় আহত ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি আবু জাহির বলেন, ‘কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে আসামিদের গর হাজিরার কারণে বিচার কার্যে বিলম্ব হচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলে শিগগিরই হত্যাকারী ও পরিকল্পনাকারীদের বিচার হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।’