রাজনীতি কী অদ্ভুত। কত কিছুই না বদলে যায়। এত দ্রুত। বছর চারেক আগে হেফাজতে ইসলামের উত্থান ছিল নাটকীয়। মূলত শাহবাগের কাউন্টার থেকেই কওমি ভিত্তিক এই সংগঠনের আবির্ভাব। ঢাকায় বিরাট শো-ডাউন করে চমক তৈরি করেছিল সংগঠনটি। সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে শাপলা চত্বর থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় হেফাজত। সংঘাতে রক্তাক্ত হয় ঢাকার রাজপথ।
কে না জানে, হেফাজতে ইসলামের প্রতি বিএনপির সমর্থন ছিল প্রকাশ্য। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিবৃতি দিয়েই দলটির নেতাকর্মীদের হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে বলেছিলেন। সে আহ্বানে বিএনপির কয়জন নেতাকর্মী সাড়া দিয়েছিলেন সে বিতর্ক আলাদা। হেফাজতের অনেক নেতাও ছিলেন খালেদা জিয়ার জোটভুক্ত। যদিও সে নেতাদের সংখ্যা এখন কমে এসেছে। বিএনপিকে এ নিয়ে দেশি-বিদেশি চাপও মোকাবিলা করতে হয়েছে। হেফাজত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত পরামর্শকদের সঙ্গেও একপর্যায়ে দূরত্ব তৈরি হয় খালেদা জিয়ার।
হেফাজতে ইসলামের প্রতি সরকারের নীতি অবশ্য পাল্টাতে থাকে ধীরে ধীরে। ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে সমঝোতা প্রক্রিয়া। কর্মকর্তা আর নেতারা হেফাজত হেডকোয়ার্টারে ছুটেন দিনের পর দিন। সমঝোতা প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হেফাজত আমীর আল্লামা আহমদ শফির ছেলে আনাস মাদানী। ক্ষমতাসীনরা সাফল্যের সঙ্গেই ধীরে ধীরে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেন ‘ইসলাম কার্ড।’ চাপ আর সমঝোতা প্রক্রিয়ায় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের যোগাযোগ একেবারেই  কমে যায়। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কড়া সমালোচনার মুখেও হেফাজতের একাধিক দাবি পূরণ করে সরকার। পাঠ্যপুস্তকে আনা হয় পরিবর্তন। হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা চলে যায় ডিপ ফ্রিজে।
কওমি মাদরাসার শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতবিনিময়ের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের আলোচনায় এসেছে হেফাজত কার্ড। ওই অনুষ্ঠানে হেফাজত আমীর আল্লামা শফিও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর দাবি জানানো হয় আলেমদের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খোলাখুলিভাবেই এ দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন ভোটের রাজনীতির সমীকরণ আর ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে খালেদা জিয়ার রাজনীতি বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগ এ রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে। ইসলামপন্থিদের একটা অংশকে কাছে রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ। চমক অবশ্য এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। পরদিন বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কওমি মাদরাসার স্বীকৃতিতে খালেদা জিয়ার গায়ে জ্বালা ধরেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সরকারের অবস্থানের সমালোচনাই করেছেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামপন্থিদের একের পর এক ছাড় দিচ্ছে। আর এটা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে আঘাত করছে বলে তিনি মনে করেন। রাজনীতি বিশ্লেষক ও গবেষক সলিমুল্লাহ খান অবশ্য মনে করেন, জামায়াতসহ ইসলামপন্থি কিছু দল নিয়ে বিএনপির জোট যে রাজনীতি করছে তা বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ এ অবস্থান নিচ্ছে। এটাকে তিনি বিপজ্জনক বা আপস হিসেবে দেখতে রাজি নন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিএনপি জোটের রাজনীতি মোকাবিলা করতে হলে আওয়ামী লীগকে  ইসলামপন্থিদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যারা বাংলাদেশকে গ্রহণ করে, তাদের মিত্র করার বিষয়টি স্বাভাবিক। এটাকে ছাড় না বলে আমি উপলব্ধি হিসেবে বলবো। কারণ, মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির একটি ছিল সামাজিক সুবিচার। সেদিক থেকে দেখলে, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে অকারণে আহত করে রাজনৈতিক কোনো লাভ নেই এবং বুদ্ধির দিক থেকেও তা ঠিক নয়।’
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সরকারের কারো কারো মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের দলের এবং সরকারের অবস্থানের প্রতি সমর্থন রয়েছে। তারা মনে করেন, যারা সমালোচনা করছেন ভোটের রাজনীতিতে তাদের কোনো প্রভাব নেই। ভোট তাদের নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট আওয়ামী লীগের ব্যাপারে যেসব সমালোচনা করে তা যে সঠিক নয়, তাও জনগণ বুঝতে পারবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কওমি মাদরাসার উচ্চশিক্ষার স্বীকৃতি দেয়া মানে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কোনো আপস করা নয়। এটা রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা। জনগণের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি হেফাজতকে সন্তুষ্ট করেছে। হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ওই মূর্তি সরিয়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার ওপর আস্থা রাখেন, ভরসা রাখেন।’ আমরাও মনে করি তিনি মূর্তি সরিয়ে ফেলবেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, একটি মূর্তিকে কেন্দ্র করে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। মাওলানা আজিজুল হক বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো আন্দোলন ছিল না। আমাদের আন্দোলন ছিল নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। সরকারকে কেউ  ভুল বুঝিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে লাগিয়েছিল। কিন্তু সরকার তার ভুল বুঝতে পেরেছে। ভুল স্বীকার করেছে। বর্তমান সরকার উপলব্ধি করেছে, মুসলামনদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করা ঠিক হবে না।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে যেসব নাটকীয় ঘটনা ঘটবে তার আভাস এরই মধ্যে দেখা যেতে শুরু করেছে। রাজনীতিতে প্রভাব থাকলেও হেফাজতে ইসলাম মূলত রাজনৈতিক সংগঠন নয়। ভোটেও তারা অংশ নেবে না। কিন্তু হেফাজত যেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয় এবং বিএনপির সঙ্গে ভিড়তে না পারে সে বিষয়টিই নিশ্চিত করা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। সরকারের ভূমিকায় হেফাজতের একটি অংশও সন্তুষ্ট। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি বিএনপির জন্য রাজনীতিকে আরো কঠিন করে তুলেছে। তবে সরকারের নীতি ভোটের রাজনীতির সমীকরণ কতটা বদলাতে পারে তা কেবল অবাধ এবং স্বচ্ছ নির্বাচনেই  বোঝা যাবে। বিশ্লেষকরা আরেকটি কথাও স্মরণ করছেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই- এ কথাটিই রাজনীতির একমাত্র শেষ কথা।
ওদিকে, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, তিনজন মন্ত্রী প্রথম আলোতে সরকারের বর্তমান অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। ভালো। মেনন, ইনু ভিন্ন দুটি দল করেন। তারা হয়তো মন্ত্রিসভায় কথা বলতে না পেরে পত্রিকায় লিখেছেন। তাদের নিয়ে আমার আপত্তি নেই। আপত্তি আসাদুজ্জামান নূরকে নিয়ে। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রী। নূরের  লেখার শিরোনাম- ‘নিরাপত্তার নামে নববর্ষের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হলো  কেন? সেটা আমার বোধগম্য নয়’। আমার প্রশ্ন মাননীয় মন্ত্রী আপনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন? কাটছাঁট কেনো হলো এই প্রশ্নের জবাব আপনারই দেয়ার কথা সাধারণ মানুষকে। জানতে চাই, আপনি কার কাছে প্রশ্ন রাখছেন? তাহলে আপনি কি মন্ত্রিসভায় কথা বলার অধিকার রাখেন না? যদি না রাখেন তাহলে সে মন্ত্রিসভায় থাকবেন কেন? মন্ত্রী হয়ে আপনারা প্রশ্ন করলে আমরা সাধারণ মানুষ কি করবো? কার কাছে জানতে চাইবো?
প্রথম আলোতে লেখায় রাশেদ খান মেনন বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ের এসব ঘটনাপ্রবাহ এবং হেফাজতের সঙ্গে আপস অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, নিরাপত্তার নামে নববর্ষের অনুষ্ঠানে কাটছাঁট করা হলো কেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে। এতে রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আছে বলে শঙ্কা হয়।-এমজমিন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn