শুভ্র দেব=রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে চোখ-মুখ হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয় গোপন আস্তানায়। তারপর শুরু হয় নির্যাতন। বাঁশের লাঠি থেকে শুরু করে লোহার রড দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। ইলেকট্রিক শক থেরাপি ওদের মূল অস্ত্র। পুরুষের লজ্জাস্থানে ইট বেঁধে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কখনো প্লাস দিয়ে নখ তুলে নেয়া হয়। রক্তাক্ত ভুক্তভোগীর কান্নার শব্দ শোনানো হয় স্বজনদের। দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে চাইলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। আর টাকা দিতে অপারগতা জানালে শুরু হয় আরো ভয়াবহ নির্যাতন। সময় যত বাড়ে নির্যাতনের মাত্রাও তত বাড়ে। এভাবেই অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা মানুষকে নির্যাতন করে টাকা আদায় করে। সম্প্রতি অপহরণের শিকার হয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে আসা ভুক্তভোগীরা নির্যাতনের এমন বর্ণনা দিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, অপহরণকারীদের চাহিদা মতো টাকা না দিলে গোপন অঙ্গে ইট বেঁধে রাখা হয়। তাদের কথা না শুনলে ইলেকট্রিক শক দিয়ে চলে লোমহর্ষক নির্যাতন। আর এমন নির্যাতন চলে চাহিদা  মতো টাকা আদায়ের আগ পর্যন্ত। শুধু চাহিদামতো টাকা দিলেই মুক্তি মেলে না। ছেড়ে দেয়ার আগে বস্ত্রহীন করে যুবতীদের সঙ্গে অশালীন ছবি ও ভিডিও করে রাখা হয়। সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করা হবে বলে জানানো হয়।

ঢাকায় সম্প্রতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপহরণকারী চক্র। এসব চক্র বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে অস্ত্র ঠেকিয়ে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য টাকা আদায়। কিন্তু টাকা আদায় করতে গিয়ে তাদের অমানবিক নির্যাতনে শারীরিক, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন ভুক্তভোগীরা। এছাড়া চক্রের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে ভুক্তভোগীর পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয় ভুক্তভোগীর স্বজনরাও আছেন নানা আতঙ্কে। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি ও অশালীন ভিডিও করে রাখায় ভুক্তভোগীরা ভয়ে মুখ খুলছেন না। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দুই সপ্তাহের ব্যবধানে অপহরণকারী চক্রের ৮ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। ১৮ই জানুয়ারি সর্বপ্রথম অপহরণকারী চক্রের ২ সদস্য মিরাজ (৩৫) ও বৃষ্টিকে (২১) গ্রেপ্তার করে ডিবি’র উত্তরা বিভাগ। আর গত শনিবার দক্ষিণখানের চেয়ারম্যানপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরো ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- মো. সাদেকুল ইসলাম, মো. ইফরান, মোহাম্মদ আলী রিফাত, মো. কুতুব উদ্দিন, মো. মাছুম রানা ও গোলাম রাব্বি। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ২ রাউন্ড গুলিভর্তি ম্যাগাজিন, ১ ছুরি, ১ মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা সবাই পেশাদার অপরহরণকারী। প্রতি মাসেই ৪ থেকে ৫ জন ব্যক্তিকে অপহরণ করে। তাদের মুক্তিপণ আদায়ের কৌশল খুবই নির্মম। একেকটি চক্রে ১০ জন সদস্য কাজ করে। প্রত্যেকের কাজ আলাদা আলাদা। কেউ অপহরণ করে আনে আবার কেউ নির্যাতন করে। টাকা আদায়ের জন্য কাজ করে অন্য সদস্যরা। আর চক্রের নারী সদস্যরা রান্না করার পাশাপাশি ভুক্তভোগীর মুখ বন্ধ রাখতে তাদের সঙ্গে অশালীন ছবি ও ভিডিও করে রাখে। ডিবি’র আভিযানিক টিমের সদস্যরা বলেছে, অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের আস্তানা থেকে ছুরি, ৫৭টি ইলেক্ট্রিক্যাল ক্যাবল টাইস, স্ক্রু ড্রাইভার ও  প্লাস, লাঠি, রড পাওয়া গেছে। এগুলো দিয়েই তারা অপহৃতদের নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে। অপহরণের পর ভুক্তভোগীর সঙ্গে তারা এতোটাই নির্মম আচরণ করতো যা খুবই অমানবিক ছিল। আমাদের কাছে অনেক ভুক্তভোগী এসে সবকিছু খুলে বলছেন। কিছু কিছু ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তাদেরকে ইলেকট্রিক শক, গোপন অঙ্গে ইট বেঁধে নির্যাতন করতো। এছাড়া অপহরণ থেকে শুরু করে নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়, ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেয়া সবই তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে করে। সব সময়ই তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে।

গত বছরের ১০ই ডিসেম্বর ঢাকার কেউলা এলাকা থেকে অপহরণ হয়েছিলেন বাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকার নেয়ামত উল্লাহ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় রেন্ট-এ কারের গাড়ি চালাতেন। অপহরণকারীরা ১৪ দিন একটি গোপন আস্তানায় রেখে নির্যাতন করে প্রায় ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ছেড়েছিল। নেয়ামত মানবজমিনকে বলেন, ১০ই ডিসেম্বর রাতে আমি কেউলা এলাকা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম। এমন সময় দেখতে পাই একটি হাইয়েস গাড়ি আমার গাড়ি থামানোর জন্য সঙ্কেত দিচ্ছে। কিন্তু আমি গাড়ি না থামিয়ে সামনে এগুচ্ছিলাম। এমন সময় ওই হাইয়েসটি জোরে চালিয়ে এসে বেড়িকেড দিয়ে আমার গাড়ি থামায়। তারপর কাগজপত্র চেক করার নামে তাদের হাইয়েসের কাছে নিয়ে কয়েকজন আমাকে ধরে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির ভেতরে তোলে। তখন মাথায় রিভলভার ধরে আমার মুখে কিছু একটা দিয়ে মুখে স্কসটেপ ও কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। ১ মিনিট পরে আমি আর কিছু বলতে পারি নাই। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম অচেনা স্থানে। তিনি বলেন, জ্ঞান ফেরার পরপরই চক্রের সদস্যরা আমাকে মারধর শুরু করে টাকা দাবি করে। ২০ লাখ টাকা না দিলে আমি ও আমার পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। বেধড়ক মারধর করে তারা আমার পুরো শরীর রক্তাক্ত করেছিল। নির্যাতন সইতে না পেরে এবং বাসার লোকজনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমি তাদের মোবাইল থেকে বাড়িতে ফোন দেই। কিন্তু আমার পারিবারিক অবস্থা ওতোটা ভালো ছিল না। ২০ লাখ টাকা দিতে আমি অপারগতা জানাই। পরে চক্রের সদস্যরা আমার পারিবারিক খোঁজখবর নিয়ে ২০ লাখ থেকে কমিয়ে ১১ লাখ দিতে বলে। এই টাকাও দেয়া সম্ভব না বলার পরে তারা নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। উপায়ন্তর না পেয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য ৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা দিয়ে ১৪ দিন পর তাদের আস্তানা থেকে আমার মুক্তি মেলে। টাকা উদ্ধারের পর তারা আমার ছবি নানাভাবে তুলে রেখেছিল। পরে একদিন আমাকে ৩শ’ ফিট সড়কে চোখ বেঁধে ফেলে রেখে যায়।

২৯শে নভেম্বর উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পূর্বপাশে রাত সাড়ে ৯টার দিকে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন আনোয়ারুল ইসলাম। এ সময় তার সামনে এসে দাঁড়ায় কালো গ্লাসের একটি মাইক্রোবাস। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাইক্রোবাস থেকে ৪/৫ জন নেমে আনোয়ারুলকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে হাত-মুখ বেঁধে ফেলে। তারপর তাকে নিয়ে যায় অজ্ঞাত ও নির্জন কোনো স্থানে। তারপর অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা আনোয়ারুলের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। ভয়ভীতি ও প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে মোবাইল ফোনে আনোয়ারুলের স্ত্রী ও বড় ভাইয়ের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। চক্রের দাবিকৃত টাকা দিতে অপারগতা জানালে নির্যাতনের মাত্রা বাড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগীর স্ত্রী ও বড় ভাইয়ের মাধ্যমে অপহরণকারীরা বিকাশের মাধ্যমে ৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। মুক্তিপণ পাওয়ার পর অপহরণকারীরা ভুক্তভোগী আনোয়ারুলকে উত্তরা পূর্ব থানা এলাকার ল্যাব এইড হাসপাতালের সামনে ফেলে চলে যায়। এ ঘটনায় উত্তরা পূর্ব থানায় একটি মামলা রুজু হয়। উক্ত মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশ ছায়া তদন্ত শুরু করে।

১৩ই জানুয়ারি উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের ফাস্ট ফুড ব্যবসায়ী মিহির রায়কে ৮০ প্যাকেট খাবারের অর্ডারের কথা বলে অপরহরণ করা হয়েছিল। মিহিরের পরিবারের সদস্যরা যখন খোঁজাখুঁজি করে তার সন্ধান পাচ্ছিলেন না ঠিক তখন একটি অপরিচিত নম্বর থেকে তার স্ত্রীর মোবাইলে কল আসে। মোবাইলের ওপর দিক থেকে মিহির বলেন, তার হাত, পা, বেঁধে রেখে মারধর, ইলেকট্রিক শক দেয়া হচ্ছে। এখন ২০ লাখ টাকা দিলে অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দেবে। পরে তার স্ত্রী বিভিন্ন সময়ে অপহরণকারীদের ২ লাখ ৯১ হাজার টাকা দেন। তবুও অপহরণকারীদের ডেরা থেকে মুক্তি পাননি মিহির। তাদের দাবিকৃত আরো টাকা দেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত মিহিরকে টর্চার করতে থাকে এবং প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। স্বামীর প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে পরে ১৬ই জানুয়ারি উত্তরা পশ্চিম থানায় মিহির রায়ের স্ত্রী বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। পরে ডিবি দক্ষিণখানের চেয়ারম্যানপাড়ার হেজুর উদ্দিন রোডের একটি বাড়ির ৩য় তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে।

ডিবি’র অতিরিক্ত কমিশনার কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ?উত্তরার ব্যবসায়ী মিহির রায় অপহরণের ঘটনা তদন্ত করতে চক্রের গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সন্ধান পাওয়া যায়। চক্রটি ঢাকায় মাত্র কয়েকদিনে ৪ জনকে অপহরণ করেছে। অপহরণকারীরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ভুক্তভোগীদের অমানবিক নির্যাতন করে। তবে ভুক্তভোগী কেউই পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি। যখন আমরা বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা শুরু করি তখন অনেক ভুক্তভোগী আমাদের কাছে আসা শুরু করে। ইতিমধ্যে ৪ জন ভিকটিমই পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে কেন ভুক্তভোগীরা মুখ খুলে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অপহরণকারীরা অপহরণের পর এই চক্রের নারী সদস্যদের দিয়ে ভুক্তভোগীদের অশ্লীল ছবি তুলে রাখতো, যাতে ভিকটিম মুখ খুলতে না পারে। যদি এ বিষয়ে পুলিশ অথবা অন্য কারো কাছে অভিযোগ করে তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিকটিমের অশ্লীল ছবি ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখাতো। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন্ন হওয়ার ভয়ে তারা চুপ থাকতো। এছাড়াও, অস্ত্রের মুখে ভিকটিমদের জিম্মি করে রাখা হতো। যার ফলে তারা ভয়ে মুখ খুলতো না। এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হলে, ভয় পেয়ে বা অন্য কোনো কারণে চুপ না থেকে বিষয়টি প্রকাশ্যে অথবা গোপনে পুলিশকে অবহিত করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান পুলিশের এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn