অবৈধ বাংলাদেশিকে ফেরাতে প্রণোদনা দেবে ইইউ
মিজানুুর রহমান-ইউরোপের দেশে দেশে ‘অবৈধ’ হয়ে পড়া প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশিকে ফেরাতে প্রণোদনার প্রস্তাব করেছে ২৮ রাষ্ট্রের জোট ইইউ। এ নিয়ে ঢাকার সঙ্গে ব্রাসেলসের আলোচনাও অনেক দূর এগিয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, স্বেচ্ছায় দেশে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের পুনর্বাসনে ওই প্রণোদনা দেয়া হবে। তবে এটি সরকারিভাবে নাকি আইওএম এর মাধ্যমে দেয়া হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য ইইউ’র টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যরা ঢাকা সফর করতে পারেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটভুক্ত দেশগুলোতে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশি অবৈধ বা অনিয়মিতভাবে অবস্থান করছেন।তাদের অনেকে বৈধতা পাওয়ার আইনি লড়াইয়ে হেরে গেছেন। যাদের মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তাদের দ্রুত দেশে ফেরাতে অনেকদিন ধরেই চাপ দিচ্ছে ইইউ। গত বছরের মাঝামাঝিতে তারা এ বিষয়ে বেশ কঠোর অবস্থান নেয়। জুলাইয়ের মধ্যে অবৈধদের ফেরানো সংক্রান্ত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি) চূড়ান্ত করার সময়সীমা বেঁধে দেয়। সেই সময়ে বাংলাদেশসহ অবৈধ অভিবাসী রয়েছে এমন দেশগুলোকে ইইউ কঠিন শর্ত দেয়। অবৈধদের না ফেরালে সাধারণ নাগরিকদের ভিসা প্রক্রিয়া কঠোর করার হুমকিও দেয়া হয়। বাংলাদেশ অবশ্য সেই হুমকির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় এবং গত বছর আগস্টে ঢাকা সফরকারী ইউরোপীয় এক্সটার্নাল সার্ভিসের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (পররাষ্ট্র সচিব পদমর্যাদা) পাওলা পেম্পেলনির নেতৃত্বাধীন উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় অবৈধদের ফেরানো সংক্রান্ত এসওপি চূড়ান্ত করে। সেই আলোচনার ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এবং ইইউ’র অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী দিমিত্রিস আভ্রেমোপোলস’র মধ্যে এক বৈঠকে চূড়ান্ত চুক্তিও সই হয়। ওই চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে গত মাসে ব্রাসেলসে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকও হয়েছে। মূলত প্রণোদনা নিয়ে ওই বৈঠকেই আলোচনা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইউরোপে থাকা বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশিকে ফেরানোর বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে ‘আমানবিক’ মনে হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল রয়েছে। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে এবং ইউরোপে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও বৈধ অভিবাসনের পথ প্রশস্ত হবে। দেশগুলোতে বৈধভাবে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিক, শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীদের ভিসা প্রাপ্তি সহজ হবে। এছাড়া বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার শর্ত পূরণেও অনিরাপদ বা বিশৃঙ্খল অভিবাসনকে নিরুৎসাহিত করা জরুরি। ঢাকা ও ইইউ সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ বরাবরই অবৈধ আ অনিয়মিত অভিবাসন বিরোধী। কিন্তু তাদের ফিরিয়ে আনা এবং নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাইয়ে যৌক্তিক সময় চায় ঢাকা। তাছাড়া মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের মতো ইইউ’র অবৈধদেরও কোনোরকম জোর জবরদস্তি ছাড়াই ফেরত আনার ওপর জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে বলেন, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি আর কর্ম বা জীবিকার সন্ধানে ইউরোপে যাওয়া বাংলাদেশিদের পরিস্থিতি এক নয়। কিন্তু দু’টোর সঙ্গেই ‘মানবিকতার’ বিষয় রয়েছে। বিষয়টি আমলে নিয়েই ইউরোপে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের একটি উন্নয়ন মডেলের অধীনে ফেরত আনতে নিয়ে আসার আলোচনা শুরু হয়েছে ঢাকা ও ব্রাসেলসের মধ্যে। উভয় পক্ষ এ বিষয়ে অনেকটাই কাছাকাছি অবস্থানে পৌঁছেছেন যে যারা নিজে থেকে ফিরতে আগ্রহী তাদের উৎসাহ দিতে প্রণোদনাই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। কারণ অনেক অর্থ খরচ করে বাংলাদেশিরা ইউরোপে যান। প্রধানত অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জীবন গড়তেই তারা দেশগুলোতে পাড়ি জমান। বাংলাদেশের জন্য ইইউ এরই মধ্যে ১২ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দও করেছে জানিয়ে অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, কেবল বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশের সঙ্গে ইইউ’র এমন মডেল কার্যকর রয়েছে। ব্রাসেলসের সঙ্গে এ নিয়ে পৃথক চুক্তি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, চুক্তিতে ফেরত আসা ব্যক্তিদের উন্নয়ন মডেলের আওতায় পুনর্বাসনের জন্য অর্থ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) পরিসংখ্যান অধিদপ্তর ইউরোস্ট্যাটের গত বছর প্রকাশিত তথ্য মতে, ইইউভুক্ত দেশগুলোয় ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন মোট ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করেন ২০১৫ সালে, ২১ হাজার ৪৬০ জন। ২০১২ সালে ইউরোপে যান ১৫ হাজার ৩৬০ জন বাংলাদেশি। বাংলাদেশ এতদিন এ সংখ্যাকে অবিশ্বাস্য মনে করতো। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন সেই সংখ্যা এতদিনে এক লাখ অতিক্রান্ত হয়েছে বলেই তারা তথ্য পাচ্ছেন।