অভাব অনটনে হাওর পাড়ের মানুষের দিনযাপন
এ বছর অসময়ে পানি এসে হাওরাঞ্চলের বোর ধান তলিয়ে যাওয়ায় হাওর পাড়ের মানুষের দিন কাটছে এখন অভাব, অনটনের মধ্য দিয়ে। হাওরবাসীরা বলেছেন, একদিকে অসময়ে হাওরের বোর ধান গেল, অন্যদিক তাহিরপুর সীমান্তের তিনটি শুল্কস্টেশন (বড়ছরা, ছারাগাও, বাগলী) দিয়ে আইনগত জটিলতার কারণে কয়লা আমদানি বন্ধ থাকায় হাওর ও সীমান্তবর্তী মানুষরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। জীবিকার তাগিদে রাতের আধারে মাছ ধরতে গিয়েও হাওরে বিভিন্ন ইজারাদারদের কারণে মাছ ধরতে পারছেন না তারা। ফলে হাওর ও সীমান্তবর্তী এলাকায় কাজকর্ম না থাকায় অনেক মানুষই জীবিকার তাগিদে অন্যত্র চলে যাওয়ায় হাওর এলাকায় এ বছর ঈদের আমেজ নেই বললেই চলে। উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাজী খসরুল আলম বলেন, ‘এলাকায় কাজকর্ম না থাকায় প্রতিদিন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ছেলে-মেয়েদের ৩০ থেকে ৪০টি পরিচয়পত্র ও নাগরিক সনদপত্র নিয়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে কাজকর্ম করার জন্য।’
শ্রীপুর বাজারের মুদি মালের ব্যবসায়ী দুলাল কান্তি পাল বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষ অবহেলিত হাওর পাড়ের অসহায় লোকজন বর্তমানে কেমন আছে তার খোঁজখবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না। অথচ ভোটের সময়ে হাওরবাসীর দ্বারে দ্বারে ঘুরেন তারা। কিন্ত কষ্টের সময়ে তাদের পাওয়া যায় না।’ হাওর পাড়ের বাগলী গ্রামের খালেক মোশারফ বলেন, ‘এ বছর হাওর এলাকার মানুষের বর্ষাকালীন জীবনচিত্র বড়ই করুণ। হাওর পাড়ের যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থার মাঝে চলছে হাওর পাড়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন।’
হাওর পাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার উত্তর শ্রীপুর, দক্ষিণ শ্রীপুর, উত্তর বড়দল, দক্ষিন বড়দল তাহিরপুর সদর, বাদাঘাট, বালিজুড়ি ইউনিয়নসহ ৭টি ইউনিয়নের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন হল শুস্ক মৌসুমে ধান চাষ করা ও বর্ষা মৌসুমে হাওরে মাছ ধরে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। হাওর পাড়ের কৃষকদের প্রতি বছরই বন্যা, শিলা বৃষ্টি ও খরার করাল গ্রাসে কৃষকের কষ্টের সোনালী ফসল নষ্ট হয়। প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসল নষ্ট হওয়ার পরও যে ধান তারা গোলায় তুলতেন তা দিয়ে কৃষকদের কোনো রকম জীবন চলতো। কিন্ত এবছর অসময়ে পানি এসে হাওরের বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ায় তারা এখন দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিনপার করছেন। স্থানীয় জনতা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোদাচ্ছির আলম সবুল বলেন, ‘শিক্ষা সংস্কৃতিতে হাওর পাড়ের মানুষ অনেক পিছিয়ে। হাওরে স্থায়ী বেড়ি বাঁধ ও হাওর পাড়ের গ্রামগুলোতে বন্যা প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় হাওর এলাকার লোকজনকে সবসময় বন্যা মোকাবেলা করেই বাঁচতে হয়।’
বানিয়াগাও গ্রামের সুজন মিয়া বলেন, ‘হাওর এলাকার বেশির ভাগ মানুষের চিকিৎসা ক্ষেত্র হল কমিউনিটি ক্লিনিক, সাব-সেন্টার ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কমিউনিটি সেন্টার ও সাব-সেন্টার প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে যারা কর্মরত আছেন তাদের মধ্যে অনেকেই বেশির ভাগ অনুপস্থিত থাকেন। হাওর পাড়ে সঠিক চিকিৎসা সেবার কারণে জীবাণুঘটিত নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, সদি,র্ জ্বর হয়ে প্রতি বছরই বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে অনেক শিশু-কিশোর। হাওর এলাকায় এখন অশিক্ষা ও অভাব থাকায় খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, হত্যা, আত্মহত্যা, চোর-ডাকতের উপদ্রব দেখা দিয়েছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হাওর পাড়ের গ্রামগুলোতে সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘আমরা হাওর বাসী’ নামক সংগঠনের প্রধান সমন্বকারী রুহুল আমীন বলেন, ‘এ বছর অসময়ে পানি এসে হাওরের বোরো ধান তলিয়ে যাওযায় হাওর এলাকার মানুষ এখন খুব কষ্ট করে দিনপার করছেন। হাওর এলাকার মানুষের দাবী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করা হচ্ছে, যাতে হাওর বাসীর জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়ন গঠন করা হয়। সরকার যদি হাওর এলাকার উন্নয়নের কথা চিন্তা করে পৃথক মন্ত্রণালয়ন গঠন করেন তাহলে হাওরবাসীর দুঃখ-কষ্ট একটু হলেও দূর হবে।’