‘মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন বিপথে যাচ্ছে’- এমন প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বলেছেন, ‘যেসব ছেলে-মেয়ে বিপথে যাচ্ছে তাদের অভিভাবকরা (পিতা-মাতা) উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তারা তাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে পারেন না। তাই তাদের সন্তানরা গোল্লায় (বিপথে) যায়।’ আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘আমরা (বিচারপতিরা) এ মামলার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয়ে খোঁজখবর এবং দুপক্ষের আরগুমেন্ট থেকে দেখেছি, আসামি মুফতি জসিম বাদে বাকি সকলেই (সাত আসামি) মেধাবী শিক্ষার্থী। কিন্তু তারা কেন বিপথে গেলেন? এটা আমরা এ মামলায় খুঁজে পাইনি। তবে এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর বিপথে যাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এজন্য আমরা অভিভাবকরা অনেকাংশে দায়ী।’

রোববার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট এসব কথা বলেন। হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রোববার বিচারিক আদালত যে রায় দিয়েছিলেন তা বহাল রাখেন। রায় ঘোষণার আগে ওই মামলার পর্যবেক্ষণে আদালত অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘আমরা নিজেদের লাইফস্টাইল কীভাবে উন্নত করা যায় সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আমাদের বাচ্চাদের মানসিক অবস্থার কথা, তারা কি করতে চায়, কোন বিষয়ে পড়তে চায়, তা না জেনে তার মনের বিরুদ্ধে অনেক কিছু চাপিয়ে দেই।’ আদালত বলেন, ‘এ কাজের জন্য প্রাইমারি শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিবেশ, রাজনীতি, ধর্মীয় আচার-ব্যবহার, স্বাধীনতার ইতিহাস যথাযথভাবে শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে। এ নিয়ে সবাইকে এবং সরকারকেও ভাবতে হবে।’

ইমামদের উদ্দেশ্যে আদালত বলেন, ‘ইমামদের কাজ হচ্ছে মুসল্লিদের নামাজ পড়ানো এবং ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া। এমন কোনো বয়ান দেবেন না, যা দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।’ আদালত বলেন, ‘যদি কেউ ইসলাম এবং হজরত মুহম্মদ (সা.) অথবা যেকোনো ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে, তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারও নেই।’ পর্যবেক্ষণে আদালত আরো বলেন, ‘শরিয়াহ আইন আমাদের দেশে প্রচলিত কিনা সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে।’ মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্যগ্রহণ বিষয়ে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘মুফতি যেখানে খুতবা দিতেন সেখানকার মুসল্লিদের প্রসিকিউশনের আওতায় আনা হয়নি। আইজিপিকে আহ্বান জানাচ্ছি, সব ধরনের মামলায় এমন সব কর্মকর্তা নিয়োজিত করতে হবেন, যারা শুধু নিজের নয়, দেশের জন্য কাজ করবেন।’

আদালত বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত। একদল হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছে। অন্যরা তথ্য সংগ্রহ করেছে। বিচারিক আদালতের রায় পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পাইনি। সেজন্য বিচারিক আদালতের রায়ই বহাল।’ মামলার বাদী রাজীব হায়দারের বাবার রিভিশন আবেদনের বিষয়ে আদালত বলেন, ‘এ মামলায় আসামিদের সাজা বৃদ্ধির জন্য বাদীর পক্ষ থেকে একটি রিভিশন আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু আবেদনের শুনানির জন্য কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।’

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে রাজধানীর পল্লবীতে তার বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। ওই মামলায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রেদোয়ানুল আজাদ রানা (পলাতক) ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ে মাকসুর হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। একই সঙ্গে প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। এছাড়া আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানিকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আসামি সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত।

পরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফয়সালসহ সাতজন আপিল ও জেল আপিল করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যজন রানা পলাতক থাকায় আপিল করেননি। রায়ের পর গত বছরের ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স আসে। সাজা বাড়াতে ক্রিমিনাল রিভিশন আবেদন জানান রাজীবের বাবা। পরে প্রধান বিচারপতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের পর পেপারবুক ছাপানোর জন্য সরকারি ছাপাখানায় পাঠানো হয়। রোববার মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে আসামিদের আপিল খারিজ করে দিয়ে আদালত নিম্ন আদালতের দেয়া দু’জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn