অরফানেজ ট্রাস্টের জমি আছে, এতিমখানা নেই
এতিমখানা কেন করা হয়নি- এমন প্রশ্নে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ও পরে বিএনপি ক্ষমতায় না থাকায় এখনও কিছু করা হয়নি। তবে এই টাকা আসার পরেও বিএনপি আট বছর ক্ষমতায় ছিল। আর প্রধান বিরোধী দল ছিল আরও ১০ বছর। এই সময়ে এতিমখানা কেন করা যায়নি, সে প্রশ্নের কোনো জবাব নেই খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের কাছে। আমিনুল ইসলাম বলেন, একই টাকায় দুইটি ট্রাস্ট হয়েছে; জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। জিয়া মেমোরিয়ালের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি। খালেদা জিয়া রায়ের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কুয়েতের আমির যে টাকা দিয়েছেন, সেটি ব্যক্তিগত টাকা, রাষ্ট্রীয় তহবিল নয়। তবে মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, ‘এটা সরকারি তহবিলের টাকা। এটা উনার (খালেদা জিয়া) ব্যক্তিগত টাকা নয়। এই টাকা তিনি ব্যক্তিগত ট্রাস্টকে দিতে পারেন না। উনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে দিয়েছেন। এটা এতিমদের টাকা, টাকা কি কোনো এতিম পেয়েছে? পায় নাই।’
মামলা তিনটি ধারায়
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলায় মোট তিনটি অভিযোগ এনেছে দুদক। প্রথমত দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৪৭ সালের ৫(২) ধারায় ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ধারায় সাজার মেয়াদ সাত বছর। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। যার সাজা যাবজ্জীবন কারদণ্ড। এ ছাড়া ১৮৬০ সালের ১০৯ ধারায় অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। কোনো অপরাধের সহযোগিতার শাস্তি নির্ধারিত থাকলে সেটি, আর যদি শাস্তি নির্ধারিত না থাকে তাহলে মূল অপরাধের শাস্তির সমাপরিমাণ শাস্তির বিধান রয়েছে এ ধারায়।
বিদেশ থেকে আসা টাকায় দুটি ট্রাস্ট
১৯৯১ সালে বিদেশ থেকে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার আসে। ওই সময়ে যা বাংলাদেশি টাকায় ছিল চার কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ১৯৯৩ সালে জিয়া অরফানেট ট্রাস্ট এবং জিয়া মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করে টাকা সমানভাবে ভাগ করে টাকা হস্তান্তর করা হয়। ওই সময় ব্যাংকে সুদ বেড়ে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। প্রতিটি ট্রাস্টকে ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা করে দেয়া হয়। বাগেরহাটে মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বর্তমানে অস্তিত্বশীল থাকায় ওই ট্রাস্টের কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি দুদক। কিন্তু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে কোনো এতিমখানা অস্তিত্বশীল না থাকার অভিযোগ এনে এ ট্রাস্টের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
টাকার উৎস নিয়ে দুই পক্ষের আইনজীবীদের দুই ধরনের মন্তব্য
যে টাকা নিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেই টাকার উৎস নিয়ে দুদক এবং খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা বক্তব্য দেয়া হয়েছে আদালতে। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টাকাটা এসেছে সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে। টাকা পাঠানোর বিষয়ে ডিডির একটি ফটোকপি মামলার সাথে জমা দিয়েছে দুদক। তবে কে এবং কোন উদ্দেশ্যে টাকাটা পাঠিয়েছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি দুদক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে তথ্য দেয়ার জন্য দুদকের পক্ষ থেকে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছিল। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংকটির অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। এটি সাম্বা গ্রুপের সাথে মিশে গেছে। এদিকে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতি রক্ষার্থে টাকাটা দিয়েছে তৎকালীন কুয়েতের আমির। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান এই টাকাটা ব্যক্তিগতভাবে কুয়েতের আমিরের কাছ থেকে এনেছেন। কুয়েতের দূতাবাসের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি এফিডেভিট করা নথি আদালতে জমা দিয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। তবে এতে কত টাকা দিয়েছে এ বিষয়ে কোনো কথা লেখা নেই।
খালেদা জিয়া যেভাবে আসামি
দুদকের পক্ষ থেকে এ মামলায় দাবি করা হয়েছে, জিয়া অরফানাজের টাকা রাষ্ট্রীয় এতিম তহবিলের। তবে এতিম তহবিলর মূলনথি জমা দেয়া হয়নি। এ সংক্রান্ত একটি উপনথি বা ছায়ানথি তারা আদালতে জমা দিয়েছে। দুদকের দাবি, মূল নথি তৎকালীন মুখ্যসচিব কামাল উদ্দীন সিদ্দিকী গায়েব করেছেন। এজন্য মূলনথি পাওয়া যায়নি। সৌদি থেকে এই টাকা আনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মূখ্য সচিব কামাল উদ্দীন সিদ্দিকী এতিম তহবিল নামে সোনালী ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। তিনিই প্রধানমন্ত্রীর তহবিল দেখাশোনা করতেন। পরে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাটা তোলা করা হয়। খালেদা জিয়ার নির্দেশে টাকাটা কামাল উদ্দীন সিদ্দিকী দুইটি ট্রাস্টে সমানভাবে ভাগ করে দেন। ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা যায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে এবং ২ কোর্টি ৩৩ লাখ টাকা দেয়া হয় জিয়া মেমোরিয়াল ট্রাস্টকে। এ জন্য কামাল উদ্দীন সিদ্দিকীকেও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ঠিকানা ব্যবহার করা হয় সেনানিবাসে শহীদ মঈনুল রোডে খালেদা জিয়ার সে সময়ের বাসার ঠিকানায়। ট্রাস্টের সেটেলার হলেন তার বড় ছেলে তারেক রহমান এবং ট্রাস্টি হলেন, তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো এবং জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। পরে ব্যক্তিগতভাবে এফডিআর করে টাকাটা সেখানে হস্তান্তরের মাধ্যমে তারা টাকাটা আত্মসাৎ করেন। দুদকের দাবি বিষয়টি খালেদা জিয়া জানতেন এবং তার সহযোগিতায় টাকাটা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ কারণে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক, কোকো ও মমিনুর রহমানও আসামি হয়েছেন।
ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ যেভাবে আসামি
শরফুদ্দিন আহমেদ তার ঢাকার আশুলিয়ার জমি বিক্রি করার জন্য জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে বায়না চুক্তি করেছিলেন। ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ বায়না বাবদ ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা অগ্রিম হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে টাকা বা জমি কোনোটাই না দেয়ায় ট্রাস্টের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। ২০১২ সালে ওই মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার পর তিনি ওই টাকা সুদসহ ট্রাস্টকে ফেরত দেন।
কাজী সালিমুল হক কামাল যেভাবে আসামি
বিএনপির সাবেক সংষদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল তৎকালীন প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। ট্রাস্টের এক কোটি ৮০ লাখ টাকা তার নামে এফডিআর করা হয়। পরে অবশ্য তিনি সুদসহ এই টাকা ট্রাস্টকে ফেরত দেন।
২ কোটি ১০ লাখের মামলা কেন
এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে জিয়া অরফানেজ মামলাটি করে দুদক। শরফুদ্দিন আহমেদের নিকট থেকে ঢাকার আশুলিয়া থেকে জমি কেনার জন্য ওই টাকার একটি বায়না করা হয়েছিল। বাকি টাকা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে থাকায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেনি দুদক।
কবে মামলা হয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতা থাকাকালীন ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট দুদক আসামি দের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। মামলার তদন্ত ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হলেন দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশিদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার পর থেকে শুরু হয় বিচার। ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। একই বছরের ৭ মে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে এ দুটি মামলা বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাটি ২৩৬ কার্য দিবসে শেষ হয়েছে। এরমধ্যে ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া, ২৮ কার্য দিবস আসামি পক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থন ও ১৬ কার্য দিবস যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়।
-ঢাকাটাইমস