আওয়ামী লীগের তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা:নিয়ন্ত্রনে আসছেনা
আওয়ামী লীগের তৃণমূলে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কুমিল্লা, নরসিংদী, চট্টগ্রাম মহানগর, ফরিদপুর ও শরীয়তপুরে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন নেতাকর্মীরা। এতে তিনজন নিহত ও অনেক হতাহত হয়েছেন। ভয়াবহ কোন্দলে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের ৩০টি সাংগঠনিক জেলা। এর মধ্যে আজ রোববার কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ চুয়াডাঙ্গা জেলার নেতাদের ঢাকায় তলব করেছে। আগামীকাল সোমবার যশোর, এপ্রিলের ২৫ তারিখ সাতক্ষীরা, ২৭ তারিখ নীলফামারী জেলার নেতাদের কাছ থেকে কোন্দলের হেতু শুনবেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
এ ছাড়া কোন্দলে জর্জরিত সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম মহানগর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কুমিল্লা উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা জেলা, রাজশাহী জেলা, নাটোর, নওগাঁ, বরিশাল মহানগর, ভোলা, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কোন্দল ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন্দলে বিপর্যস্ত ও ঝিমিয়ে পড়া তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে যখন জেলায় জেলায় সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াতে আওয়ামী লীগ নেতারা মাঠে নামছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের কঠোর বার্তা আর বিভিন্ন জেলা সফরের মধ্যেই; নতুন করে সেই পুরনো কোন্দলে জড়াচ্ছেন দলের তৃণমূল নেতারা। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দ্বন্দ্ব চট্টগ্রাম মহানগর, খাগড়াছড়ি, খুলনা, রাজশাহী, নাটোরে। এমপি-নেতায় দ্বন্দ্ব বান্দরবান, নরসিংদীতে। কুমিল্লায় দ্বন্দ্ব চতুর্মুখী। জেলার নেতা, সাবেক নেতা-এমপি-মন্ত্রী নানা উপদলে এসব জেলার কোন্দল মাঝে মাঝেই প্রাণসংহারী হয়ে ওঠে।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব কোন্দল নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় রয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড। সম্প্রতি কুমিল্লা সিটি নির্বাচন ও সিলেটে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় কোন্দলে ভরাডুবি হয়েছে দলীয় প্রার্থীর। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এসব কোন্দল ওপেন সিক্রেট। দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। জাতীয় নির্বাচনের আরো দেড় বছর বাকি। তাই এসব কোন্দল নিরসনের সুযোগ রয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিনিধি সম্মেলনের পর জেলা পর্যায়েও নিয়মিত বৈঠক করে সংগঠনকে গতিশীল রাখবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা। সাংগঠনিক সম্পাদকদের সারাদেশে দলীয় কোন্দলের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে কেন্দ্রে জানানোর জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ে চলমান জেলা ও বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন এক যাত্রা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। এ যাত্রার মূল লক্ষ্য আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃণমূলের কোন্দল চিহ্নিত করা। এর পাশাপাশি এসব সম্মেলন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নতুন করে উজ্জীবিত করবে, ঝিমিয়েপড়া ভাব কাটিয়ে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠবেন তারা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের কোন্দল নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কুমিল্লা ও সিলেটের নির্বাচন দলের হাইকমান্ডের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। এসব কোন্দল মেটানোর জন্য এখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইতে পারেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
৩০ মার্চে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দল বেঁধে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মাসব্যাপী চেষ্টা করেও কোন্দল নিরসন করে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারেননি। তবে এর আগে নারায়ণগঞ্জে একই প্রেক্ষাপটে দলীয় প্রার্থীর জয় সম্ভব হয়েছে। কুমিল্লায় সাংগঠনিক জটিলতা বহুমাত্রিক। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এখানকার জটিলতা আরো বাড়তে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কোন্দল মেটাতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে আরো কঠিন হতে হবে। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী কোন্দলে ভরা এমন অনেক জেলায় সফর করবেন। শুরুতেই বিএনপি অধ্যুষিত এবং দলীয় কোন্দল রয়েছে এমন জেলাগুলোতেই তিনি যাবেন। ইতিমধ্যে ২৯ মার্চ কোন্দলে বিপর্যস্ত ফরিদপুরে তিনি জনসভা করেছেন। দলের সব নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দলীয় কোন্দল রয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলাতেও। সেখানেও তিনি সফর করবেন। দ্বিতীয় দফায় তিনি সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে সফর করবেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পনের বছর পর আওয়ামী লীগের সিলেট বিভাগীয় তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২২ মার্চ। এ সম্মেলনকে ঘিরে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্যরকম এক চাঞ্চল্য ফিরেছে। কোন্দলও চিহ্নিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কোন্দলের কারণে প্রতিনিধি সভায় এ জেলার কাউকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হয়নি। টানা তিনবারের সাংগঠনিক সম্পাদক মেসবাহ উদ্দিন সিরাজ প্রতিনিধি সভায় আগামী নির্বাচনে বর্তমান এমপি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। এতে মুহিত মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের সিলেট বিভাগীয় তৃণমূল সম্মেলনে মেসবাহ যখন বক্তৃতা দিতে ওঠেন তখন মঞ্চে বসা ছিলেন সিলেট-১ আসনের টানা দুইবারের এমপি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সিলেট-১ আসনে অর্থমন্ত্রী মুহিতের ভাই, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত এ কে আবদুল মোমেন প্রার্থী হচ্ছেন বলে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক দিন ধরে কানাঘুষা চলছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলনগুলোকে একটু জাঁকজমক করে একটা নির্বাচনী আবহ দেয়ারও চেষ্টা করছেন। প্রস্তুতি শেষ করতে না পারায় এবং কিছু জটিলতা থাকায় প্রথম নির্ধারিত তারিখ ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের বরিশাল বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন পিছিয়ে গেছে। তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এপ্রিল মাসের মধ্যেই বরিশাল বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন। খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতেও আংশিকভাবে এ রকম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সব জেলার প্রতিনিধিদের নিয়ে দেশের সব ক’টি বিভাগে এ রকম বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে মানবকণ্ঠকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা আমাদের ভিশন ও উন্নয়ন বার্তা নিয়ে তৃণমূলে যাচ্ছি। সাংগঠনিক কোন্দলের বিষয়ে তিনি বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিভিন্ন জায়গার কোন্দল চিহ্নিত করছেন। এসব বিষয়ে তারা তাদের রিপোর্ট উপস্থাপন করবেন। দলীয় ফোরামে এসব নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এ ভূখণ্ডের সবচেয়ে প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের পরিধি ও ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। সারা বছরই দলের সাংগঠনিক কাজ থাকে। এত বড় দলে ছোট-খাট কোন্দল থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তৃণমূলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে (লিডারশিপ) সবার শতভাগ আস্থা রয়েছে। তৃণমূলে সাংগঠনিক কাজ চলছে; নেতাদের বিভিন্ন কোন্দল, মান-অভিমান চিহ্নিত হচ্ছে, আরো হবে। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত হবে। আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সুশৃঙ্খল দল হিসেবেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেব।
কোন্দলের পাশাপাশি একদম রুট তৃণমূল যাকে বলে সেই ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কমিটি শক্তিশালী করা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, দলের বিভিন্ন জেলা ও মহানগর ইউনিটের ওয়ার্ড কমিটির আওয়ামী লীগের অনেক নেতার হদিস পাওয়া যায় না। নানা কারণে দল থেকে দূরে সরে আছেন। এদের মধ্যে কোনো কোনো কমিটির সভাপতি-সম্পাদক থেকে শুরু করে ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির ৫০ ভাগের বেশি ঝরে পড়েছেন। আওয়ামী লীগের চলমান ‘তৃণমূল অভিযানে’ এসব তথ্যও বেরিয়ে আসছে। তাই এসব ইউনিটে দ্রুত নতুন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জানা যায়, বরিশাল মহানগর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কর্মিসভা করার উদ্যোগ নেয়। ৩০টি ওয়ার্ডের কর্মিসভায় ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির কোনো কোনোটায় মাত্র ২০-২৫ জন নেতাকে উপস্থিত পাওয়া গেছে। আবার কোনোটায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ নেতা উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, প্রায় যুগপূর্তির এসব কমিটিগুলোর কেউ বেঁচে নেই, কেউ নিষ্ক্রিয়, কেউ চাকরি করেন, আবার কেউ সরে গেছেন। এ সমস্যা দেশের অধিকাংশ জেলাতেই। দেড় বছর হাতে রেখে সাংগঠনিক তৎপরতা ও নির্বাচনী প্রচারের কারণে এ বিষয়গুলোরও সুরাহা করছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, তৃণমূলের এসব কোন্দল আপাতত দলীয় নেতারা সুরাহা করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা এসব কোন্দল কতটা মিটাতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। শেষ পর্যন্ত এসব কোন্দল সুরাহা করতেও প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকেই হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে।