আকবর ইস্যু : ক্রেডিট নিয়ে টানাটানি!
পরশ তুহিন : সিলেটে রায়হান হত্যার প্রধান আসামি এসআই আকবর হোসেনকে (বরখাস্ত) ভারতীয় খাসিয়াদের সহযোগিতায় গ্রেফতার করেছে পুলিশ। খাসিয়াদের তাকে আটকের কয়েকটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরালও হয়েছে। কারা, কীভাবে কোন অবস্থায় আকবরকে ধরেছে তা ভিডিও’তে দেখা যায়। পরিচয় গোপন রাখতে এদের মধ্যে কয়েকজনের মুখও বাঁধা দেখা গেছে। তবে জেলা পুলিশ এসআই আকবর গ্রেফতারের ক্রেডিট দাবি করেছেন নিজেরাই। সোমবার (৯ নভেম্বর) আকবর গ্রেফতারের বিষয় জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন প্রেস ব্রিফিংয় করেন। এসময় তিনি বলেন, ‘আকবর সীমান্ত এলাকা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে এরকম তথ্য পুলিশের কাছে ছিল। তথ্যটি আমরা রবিবার (৮ নভেম্বর) পাওয়ার পরপরই অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছিলাম। সেইসঙ্গে অভিযানকারী দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সিলেটের কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানার ওসিকে। যেহেতু ওই দু’টি থানায় সীমান্ত এলাকায়। পুলিশের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে আকবরকে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।’
পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্যারের প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছিল এ বিষয়ে। এছাড়া সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি স্যারও সার্বক্ষণিক এই বিষয়ে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’একটি ভিডিওতে দেখা গেছে ভারতের খাসিয়ারা তাকে আটক করেছে– এমন প্রশ্নে পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে কোনও ভিডিও করা হয়নি। এ ভিডিও কে, কোথায় করেছে তা জানা নেই। তবে আকবরকে জেলা পুলিশের কানাইঘাট থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে।’ পুলিশের কাছে কেউ হস্তান্তর করেছে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আকবরকে কেউ হস্তান্তর করেনি। পুলিশ তাকে ধরেছে। কিন্তু আমরা পুলিশের সব কাজে জনগণের সহযোগিতা পেয়ে আসছি। তাকে গ্রেফতারে আমাদের কিছু বন্ধু সহযোগিতা করেছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পুলিশ আকবরকে নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। ফেসবুকের কল্যাণে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবী দেখেছে আকবরকে কোথায় থেকে কারা ধরছে কিভাবে ধরছে। এটা নিয়ে মিথ্যাচার করা কোনভাবে উচিত হয়নি। এমনতি তে পুলিশ প্রশ্নবিদ্ধ কারণে নানা প্রশ্নের মুখে রয়েছে। যারা আকবরকে ধরছে তাদেরকে যদি পুলিশ কৃতজ্ঞতা জানাত তাহলে পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বৃদ্ধি পেত। স্থানীয়দের হাতে আকবরের আটক হওয়ার কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিও’র একটিতে আকবরকে বসিয়ে রেখে হাত-পা বাঁধছিলেন স্থানীয়রা। এসময় আকবর বলছিল, ‘আমি ভাগমু না ভাই, আমি ভাগমু না।’ তখন খাসিয়াদের একজন তার নাম জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমি আকবর।’ তখন স্থানীয়রা বলাবলি করতে থাকে, ‘১০ হাজার টাকার জন্য তুমি মানুষ মারছো’, ‘তুমি রায়হানরে হত্যা করছো’। আকবরকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি মারি নাই, আমি হাসপাতালে নিয়া গেছি’। এ সময় আকবরের বেশভূষা ছিল অনেকটা স্থানীয়দের মতোই।
গলায় পুতির মালা, খয়েরি রঙের শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা ছিল সে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তাকে স্থানীয়দের মতোই লাগছিল। স্থানীয়রা পরে তাকে হাত ও পা বেঁধে হাঁটিয়ে পাহাড় ও জলাভূমি পার করে নিয়ে আসে। এ সময় স্থানীয়রা তাকে পানির বোতল দেয় এবং যারা তাকে নিয়ে আসছিল তাদের আকবরকে না মারার পরামর্শ দিতেও শোনা যায়। অপর একটি ভিডিওতে আকবরকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি খুনি না, আমি মারিনি। ইচ্ছা করে মারিনি। আমি একা মারিনি, পাঁচ-ছয় জন তাকে মেরেছে। আমি তো হাসপাতালে নিয়া গেছি। সেখানে সে মারা গেছে।’ আকবরকে বলতে শোনা যায়, ‘সে (রায়হান) ছিনতাই করেছিল, তাকে পাবলিকে মারছে। আমি তো হাসপাতালে নিয়া গেছি।’ এসময় স্থানীয়রা তাকে প্রশ্ন করে, তাহলে তুমি পালালে কেন? তখন আকবর বলে, ‘আমার দুই সিনিয়র আমাকে বলেছে, যেহেতু সাসপেনশন হয়েছ, আপাতত পালিয়ে যাও। দুই মাস পর ঠান্ডা হলে এসো। তখন বিষয়টা হ্যান্ডেল করা যাবে।’ অপর এক ভিডিওতে দেখা যায়, পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় আকবর দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয়দের কাছে আকুতি জানিয়ে বলছেন, ‘তোমরা বলো আমাকে মারবা না, বলো ভাই আমাকে মারবা না।’ তখন স্থানীয়রা বলতে থাকে, ‘না বসো, তোমাকে মারবো না। তোমার লাখান আমরা মারবো না।’ এসময় আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘চুপচাপ বসো, নয় তো নিচে ফেলে দেবো’।
সিলেট নগরীর আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হান আহম্মদকে গত ১০ অক্টোবর রাতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরের দিন ১১ অক্টোবর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ১২ অক্টোবর ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেনসহ চার জনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়। পরের দিন থেকে তিনি লাপাত্তা ছিলেন। বরখাস্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন, বন্দরবাজার ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস। প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন। এদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশীদ ও টিটু চন্দ্র দাস। এছাড়াও কারাগারে রয়েছেন ছিনতাইয়ের অভিযোগকারী সাইদুর রহমান। সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) লুৎফর রহমান বলেন, ‘আকবর যাতে সিলেটের সীমান্ত পথ ব্যবহার করে পালিয়ে না যায় সেজন্য সর্তক ছিল থানা পুলিশ। পুলিশ আকবরকে বাংলাদেশ সীমানা থেকে গ্রেফতার করেছে। আকবর ভারতে পালাতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। ’