আগস্ট এলেই শঙ্কিত হই-কামাল লোহানী
আগস্টের এই প্রথম দিনে আমাকে শঙ্কিত করে তোলে ১৫ আগস্টের রোক নিন্দিত ও চক্রান্তকারী শিবিরের কুিসত হিংস্র হত্যাকাণ্ডের কথা, যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের (দুই কন্যা বাদে) নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এর পরই লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন মাতৃভূমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বুকে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিষ্পৃষ্ট করে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া আদর্শিক বাংলাদেশ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে নস্যাত্ করার চক্রান্তের সূচনা করা হয়েছিল। এরপর থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে আমরা ৪৬ বছর পার করতে চলেছি। কিন্তু গত ৪২ বছর ধরে দেশের সাধারণ মানুষ, যেসব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তাদের মুখে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে সামরিক বিশ্বাসঘাতক কর্মকর্তাদের সহায়তায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিহিংসা পরায়ণতার চিহ্ন, গভীর ঘা। যার সুযোগ গ্রহণ করে জেনারেল জিয়া এবং এরশাদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হাতে ক্রমশ সপে দিয়েছে। অর্থাত্ এইসব ক্ষমতাসীন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ও তাদের দোসরদের কাছে আত্মবিসর্জন দিয়ে রাজনীতিকে কলংকিত করছে তো বটেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সাধকে পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নানা অপকৌশল এঁকেছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যে প্রবল গণবিক্ষোভ তাকে স্মরণে রেখে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্লোগান ধর্ম নিরপেক্ষতার বাংলাদেশকে যদি গড়ে তুলতে না পারি তাহলে কেবল বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে গালভরা কথা বললেই মানুষ তৃপ্ত হবে না, দেশও কল্যাণের পথে এগুতে পারবে না।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা আলোচনা করতে গেলে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। তাই সেটা পরিহার করে একবারেই যদি বলি তাহলে বলতে হবে বঙ্গবন্ধু একটি রাজনৈতিক আদর্শের প্রণেতা হলেও এবং এই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্তিত্বের মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেও নেতাদের সঙ্গে যে স্নেহ ও শ্রদ্ধাবোধ দেখেছি ১৯৬২ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তা অবিস্মরণীয়। এমন একটি মানুষ পাকিস্তানি প্রশাসনও যাকে ভয় পেত এবং দেখেছি প্রতিটা মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করত একজন মহত্ ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকাকালে ৭০-এর দশকে দেখেছি তার মহানুভবতা এবং বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত। সে কারণেই এমন একটি মহান পুরুষের সামনে আমরা সাংবাদিকরা যে কোনো দাবি নিয়ে তার কাছে যে কোনো সময় উপস্থিত হতে পারতাম। আজ আগস্ট মাসের প্রথম দিনে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে গিয়ে এবং শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে একটি প্রশ্ন, আজ কি পারি আমরা কারো সামনে উপস্থিত হয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে আমাদের দাবি ও অধিকারের কথা বলতে? যেটা বঙ্গবন্ধুর কাছে সব সময় সম্ভব ছিল। আজকের এই দিনে এই মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্রের প্রতি আমরা যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থাকি তাহলেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান দেখানো হবে।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক