আতিক রহমান পূর্ণিয়া, সুনামগঞ্জ হাওরাঞ্চল থেকে

সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলা সদরের কাছেই হাওরের কোল ঘেঁষে খোকন মিয়াদের বাড়ি। দুতিনটি ছোট ছোট ঘরে মা আর বড় তিন ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন খোকন। খোকনদের মূল ঘরটি, যেখানে সে তার মায়ের সাথে থাকে সেটির কোনো দরজা-জানালা নেই। মাঝারি ধরনের টিনের দুচালা ঘর। ঘরে কোনো আসবাবপত্র তো দূরের কথা সামান্য খাটও নেই। সে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে খোকন মিয়া এবং তার মা-ভাইয়ের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। খোকনের ভাইয়েরা কেউ পড়াশোনা করেনি। পেশায় দিনমজুর। তারাই খোকন মিয়ার পড়াশোনার স্বপ্ন দেখেন, দেখেন ভাই যেন তাদের মতো দিনমজুর না হয়। স্বপ্ন দেখেন ভাই পড়াশোনা করে বড় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবেন। খোকন চলতি বছরে উপজেলা সদরের জয়নুল আবেদিন কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল। কিন্তু হাওরের বাঁধ রক্ষা করতে এবং হাওরে তলিয়ে থাকা কাঁচা পাকা ধান কাটতে গিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি সে। শুধু খোকন নয় তার কলেজের বন্ধু মাসুদ মিয়া এবং মোহাম্মদ রুস্তমও একই অবস্থায় পড়েছিল। তাদের কলেজের আরও অসংখ্য শিক্ষার্থী এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি।

মায়ের পাশে বসে থেকে অনেকটা হতবিহ্বল চোখে খোকন বলেন, হাওর বাঁচাইতে গিয়া পরীক্ষাটা দিতে পারি নাই। দুঃখ থাকত না যদি হাওরটা বাঁচাইতে পারতাম তাও হইল না। সেই দিন কিছু করার ছিল না। খোকন পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়- পেটের ভাত আগে না এইচএসসি পরীক্ষা আগে? খোকন জানায়, ২২ এপ্রিল পরীক্ষা ছিল। ওইদিন ভোররাতেই মানুষের চিৎকার। শনির হাওর তলাইয়া যাইতেছে। শুধু কাস্তেটা হাতে নিয়ে হাওরে দৌড় দেই। পরীক্ষার কথা কিছু মনে ছিল না। বড় তিন ভাই আর মা এ হাওরের ধানের ওপর ভরসা কইরা এতোদিন পড়াশোনা করিয়েছে। সে হাওরের ফসল ডুবলে মা ভাইয়েরাও না খেয়ে থাকত। ওইদিন হাওর রক্ষা বাঁধ যখন আর ঠেকানো যায়নি তখন পানির নিচ থেকে কোনোরকম কয়েকমণ ধান কেটে এনেছে খোকন। খোকনের মা কুলুসারা পড়াশোনা করেননি। সরল সোজা আবদার করেন-আমার ছেলেটারে আপনারা পত্রিকায় লেইখা পরীক্ষাডা আবার দেওয়ানোর ব্যবস্থা কইরা দেন।

ভাবি নাসিমাও তাতে সায় দিয়ে বলেন, সরকার চাইলে পরীক্ষাটা দেওয়াইতে পারে। খোকন বলে, এবার না হলে আগামীবার পরীক্ষাটা দিতে চাই। তার বড় ভাই জাকির হোসেন বলেন, আমিও বুঝতে পারি নাই। আমদের টানেই খোকন পরীক্ষাটা ফালাইয়া ধান বাঁচাইতে গেল। তাহিরপুর সদর থেকে আধা ঘণ্টার পথ ভাটিজামালগঞ্জ গ্রাম। সে গ্রামে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল খোকনের অপর দুই বন্ধু মাসুদ আর রুস্তম। তাদের বাড়িতে কথা হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। মাসুদ বলে, তাদের নিজেদের জমি নাই। পরিবার আর পাশের বাড়ির অনেকে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন। সে জমির ফসল যখন নিজের চোখের সামনে তুলিয়ে যাচ্ছিল তখন আর পরীক্ষার কথা চিন্তা করার সময় ছিল না। রুস্তম বলে, তাদের সামান্য কিছু জমি ছিল মাইট্যান হাওরে তা তলিয়ে গেছে আরও একদিন আগে। শনির হাওরের আর সামান্য কিছু জমি ছিল পরিবারের শেষ ভরসা। তাই আর পরীক্ষা দেওয়ার চিন্তা করার সময় ছিল না।

শনিবার টাঙ্গুয়ার হাওরে কথা হয় এইচএসসি ২য় বর্ষে পড়া শাকির আহমদের সাথে। সেও জয়নুল আবদিন কলেজের ছাত্র। কলেজ ক্যাম্পাসে কথা হয় তার সাথে। শাকির বলে, পরিবারে খাবারের কোনো ব্যবস্থা নাই। বৃদ্ধ বাবার মুখের দিকে চাইতে পারি না। তাই মাছ ধরি, পরিবারের মুখে যাই তুইলা দিতে পারি। খোকন, রুস্তম, সামুদের মতো অনেক পরীক্ষার্থী এবার হাওরে অসমের বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ায় এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি। আর শাকিরের মতো আরও কতো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে আছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn