আতঙ্ক বাড়ছে সিলেটে ১৫ দিনে চার জোড়া খুন
ওয়েছ খছরু::একের পর এক জোড়া খুনের ঘটনায় আতঙ্ক বাড়ছে সিলেটে। দেখা দিয়েছে ক্ষোভও। ১৫ দিনের ব্যবধানে সিলেটে চারটি আলোচিত জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুটি জোড়া খুনের ঘটনা হচ্ছে মা ও ছেলে। অপর দুটি হয়েছে সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে । এর পাশাপাশি সিলেটে সাম্প্রতিককালে আরো কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনাগুলো নাড়া দিয়েছে সিলেটবাসীকেও। হঠাৎ করে সিলেটে খুন বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা শঙ্কা বিরাজ করছে। পুলিশের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে প্রায় সবক’টি ঘটনারই রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। দুটি ঘটনার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে খুনের ঘটনার প্রকৃত আসামিরা এখনো ধরা পড়েনি। সমাজে নানা অস্থিরতার কারণে সিলেটে খুন সহ নানা ঘটনায় খুন বেড়েছে বলে জানিয়েছেন নগরবাসীকে। এর থেকে উত্তরণের জন্য তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার উপর জোর দিয়েছেন। সর্বশেষ গত রোববার সিলেটের কোতোয়ালি থানা পুলিশ নগরীর মিরাবাজারের খারপাড়ার মিতালী আবাসিক এলাকার ১৫-জে বাসার নিচ তলার ফ্ল্যাট থেকে মা রোকেয়া বেগম ও ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় গোটা নগরজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। আলোচিত এ ঘটনা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় নিহত রোকেয়া বেগমের ৫ বছরের মেয়ে রাইসা। পুলিশি তদন্তে এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। রোকেয়া বেগমের বেপরোয়া আচরণ আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যই তিনি খুন হয়েছেন।
পুলিশ ইতিমধ্যে রোকেয়া বেগমের প্রেমিক শহরতলির মুক্তিরচক গ্রামের নাজমুল হাসানকে গ্রেপ্তার করেছে। বুধবার পুলিশ সিলেটের কোতোয়ালি থানা পুলিশ নাজমুলকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। আলোচিত এ খুনের ঘটনার একমাত্র সাক্ষী রাইসার জবানবন্দি ও প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় নাজমুলকে। এখনো গ্রেপ্তার হয়নি তানিয়া নামের মেয়েটি। সে রোকেয়া বেগমের অনৈতিক কাজের সহযোগী ছিল বলে জানা গেছে। রাইসা এখনো সিলেটের কোতোয়ালি থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রয়েছে। পুলিশ এরই মধ্যে ধারণা পেয়েছে- নাজমুলের বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন প্রেমিকা রোকেয়া বেগম। আর এ বাধার কারণেই রোকেয়াকে খুন করা হতে পারে। তবে- রোকেয়ার বেডরুমে যাতায়াত ছিল আরো কয়েকজন পুরুষের। তারা হাই প্রোপাইল লোক। জোড়া খুনের ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কী না- পুলিশ সে ব্যাপারেও তদন্ত করছে।সিলেটের কোতোয়ালি থানার সিনিয়র সহকারী কমিশনার সাদেক কাওছার জানিয়েছেন- তদন্তে কোনো ফাকঁফোকর রাখা হচ্ছে না। যাতে নির্দোষরা কোনো হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে। তবে, প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে যে তথ্য হাতে এসেছে সেগুলো তো পরিষ্কার। জোড়া খুনের সব দিকের বিশ্লেষণ ও খোঁজখবর এক করে পুলিশ সূত্র মেলাচ্ছে। নিহত রোকেয়া বেগমের বেডরুমের লোক ছিল নাজমুল- এটি ইতিমধ্যে পরিষ্কার হওয়া গেছে।
এদিকে- গত ২৪শে মার্চ ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের একরাই গ্রামের পূর্বের হাওর থেকে নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ওই হাওরে গিয়ে একটি গলিত লাশ উদ্ধার করে। এ সময় পাশেই ৭-৮ বছরের একটি শিশুর মাথা, পা ও হাতের খণ্ড খণ্ড অংশ পাওয়া যায়। আলোচিত এ ঘটনার রহস্যও ইতিমধ্যে পুলিশ উদঘাটন করেছে। গ্রেপ্তার করেছে তিনজনকে। এর মধ্যে দুইজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ১৭ই মার্চ রাতে গোয়ালাবাজার থেকে হবিগঞ্জের মাধবপুরের মালাকারপাড়ার মৃত অমিত মালাকারের স্ত্রী দীপু মালাকার (৪০) ও তার ছেলে বিকাশ মালাকারকে (৮) অপহরণ করে একই থানার পশ্চিম পৈলনপুরের জবেদ আলীর ছেলে জকরুল মিয়া (২২), বদিয়ারচরের মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে নজরুল ইসলাম (২৭) ও মৃত আবুল কালামের ছেলে জয়নাল মিয়া (২৯)। পরে অটোরিকশা দিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় একারাই হাওরে। রাতভর হাওরে দীপু মালাকারকে ধর্ষণ করে। এ সময় ছেলে অমিত মালাকার দেখে ফেললে তাকে গলাটিপে হত্যা করে। ধর্ষণ শেষে দীপু মালাকারকেও হত্যা করে কচুরিপানা দিয়ে চাপা দিয়ে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়।
প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান চালিয়ে সোমবার রাত ৩টার দিকে ওসমানীনগরের বদিয়ারচর থেকে অপহরণ, ধর্ষণ ও জোড়া খুনে জড়িত ৩ জনকে আটক করে পুলিশ। প্রথমে তারা বিষয়টি অস্বীকার করলেও পুলিশের কৌশলী জিজ্ঞাসাবাদে তারা অপহরণ, ধর্ষণ ও জোড়া খুনে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে। ২৪শে মার্চ সিলেটের গোয়াইনাঘাটে সালুটিকরে ঘটে আরেকটি জোড়া খুনের ঘটনা। প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে খুন করা হয় দুই জনকে। এ ঘটনার পর এখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি সালুটিকরে। মসজিদের জমি নিয়ে সালিশ চলাকালে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে দুইপক্ষ। একপর্যায়ে হয় বন্দুকের ব্যবহার। গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই জন নিহত। ঘটনার একপর্যায়ে গুলিতে মিত্রিমহল গ্রামের আবদুল জলিলের ছেলে মনাই মিয়া ও আজিজুল ইসলামের ছেলে রুমেল আহমদ সেদিন নিহত হন। ঘটনার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বহর গ্রামের পুরুষরা। অন্যদিকে কান্না চলছে নিহতদের পরিবারে।
সম্প্রতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডাবল মার্ডারের নজির এটি। অবশ্য পুলিশ জড়িতদের হন্যে হয়ে খুঁজছে।
সিলেট শহরতলির বরইকান্দি এলাকায় ১৬ই মার্চ ঘটেছিল আরেকটি জোড়া খুনের ঘটনা। বরইকান্দির আলফু চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গৌছ মিয়ার পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষকালে আলফু মিয়ার পক্ষের লোকজনের গুলিতে মারা যান গৌছ মিয়ার পক্ষের শফিক মিয়ার ছেলে বাবুল মিয়া ও জমসেদ মিয়ার ছেলে মাসুক মিয়া। তবে আলফু মিয়ার স্ত্রী সুলতানা ইতিমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন নিজেদের গুলিতে মারা গেছে মাসুক ও বাবুল। ওদিকে- খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন করেছে গৌছ মিয়ার পক্ষের লোকজন। এখনো গ্রেপ্তার হয়নি আলফু চেয়ারম্যান ও তার পক্ষের লোকজন। এছাড়া গত ২৫ মার্চ সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমা এলাকায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মেহেদী আল সালাম খুন হয়েছেন । তিনি শাবির অর্থনীতি বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের সাবেক শিক্ষার্থী।
রোববার রাত(২৫ মার্চ) ১টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত তাকে ছুরিকাঘাত করে ফেলে রেখে চলে যায়। পরবর্তীতে পুলিশের গাড়িতে করে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।