আব্দুজ জহুর সেতু এলাকা কি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে?
হাসান হামিদ–
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যেদিন ভিডিও কনফারেন্স-এর মাধ্যমে ভাটি এলাকার বহু দিনের কাঙ্ক্ষিত সুনামগঞ্জ সুরমা নদীর উপর আব্দুজ জহুর সেতু উদ্বোধন করেছিলেন, সেদিন এর মধ্য দিয়ে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছিল পাশ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলার। এ সেতুটি উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে সুবিধা পাচ্ছেন বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর এবং পাশ্ববর্তী উপজেলা ধরমপাশা ও মধ্যনগর থানার ১০ লক্ষাধিক জনগোষ্টি। সেদিন সেতুটি উদ্বোধনের পর হাজার-হাজার দর্শনার্থী মেঘ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে স্বপ্নের সেতুটি স্বচক্ষে দেখার জন্য ভীড় জমান। স্বপ্নের সেতু উদ্বোধন হওয়ায় তাহিরপুরে আনন্দ মিছিল করেছিল এলাকাবাসী। এলাকাবাসীর আনন্দের কারন ছিল দু’টো; একদিকে হাওরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরন, অপরদিকে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি মরহুম আব্দুজ জহুর-এর নামে সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে আনন্দ সেদিন আকাশ ছুঁয়েছিল। সেসময় মরহুম আব্দুজ জহুর সাহেবের পুত্র জুনেদ আহমদ তার পিতার নামে সুরমা নদীর উপর নির্মিত ব্রিজটির নামকরন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-কে তার পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। আমি সেই সেতু বিষয়ে কিছু পেছনের কথা ও তারপর বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবো।
“আব্দুর জহুর” সেতুটি ৭১.১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সুরমা নদীর উপর নির্মিত ৪০২.৬১ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জেলার সবচেয়ে বড় সেতু। বাংলাদেশ সরকার ও জেডিসিএফ অর্থায়নে ২০০৫ সালে ১লা অক্টোবর সুনামগঞ্জ-কাচিরগাতি-বিশ্বম্ভরপুর সড়কের সুরমা নদীর উপর সেতু নির্মানের জন্য ২৩ কোটি ৫৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই বরাদ্দের পর ২০০৬-২০০৭ অর্থ বছরে সুনামগঞ্জ পৌরশহর সংলগ্ন মল্লিকপুর এলাকায় সুরমা নদীর উপর ১১৫ মিটার দৈঘ্য বিশিষ্ট সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অর্থ সংকটের অজুহাতে সেতুটির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ফুঁসে উঠে জেলার সর্বস্তরের জনসাধারণ। সেতুটির কাজ সম্পন্ন করার দাবীতে জেলাজুড়ে আন্দোলন শুরু হয় । সাবেক এমপি মতিউর রহমান, বর্তমান এমপি এডভোকেট পীর ফজলুল হক মিসবাহ সংসদে সুরমা সেতুর সমস্যার বিষয়টি বারবার তুলে ধরেন। অবশেষে যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সরেজমিন সেতু এলাকা পরির্দশন করে সেতুটির কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার আশ্বাস দেন। এরপর ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে নকশা পরিবর্তন করে সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ৪০২.৬১ মিটার করা হয়। এবং ব্যয় ধরা হয় ৬৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এই অর্থ বরাদ্দের পর একাধিক ঠিকাদারী প্রতিষ্টান অনিয়ম দূর্নীতির মধ্যদিয়ে প্রায় ৩ বছরে সেতুটির পাইলিং ও দুইপাশের মাটি সংযোগ কাজ শেষ করে। বাকি থাকে সেতুর মাঝের অংশের সংযোগ। আর এই সংযোগ দিতে গিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্টান আবারও নানান টালবাহানা করে সেতুর বরাদ্ধ বাড়ায়। অনেক গড়িমসির পর সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। সেতুটির সর্বসাকুল্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭১.১৩ কোটি টাকা। কিন্তু এই সেতুটির জন্য প্রায় ১০ বছর সীমাহীন দূভোর্গ পোহাতে হয়েছে জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা-মধ্যনগর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ২০ লক্ষ মানুষকে। তাদের বহু প্রতিক্ষিত এই সেতুটির নাম জেলা আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক এমপি মরহুম “আব্দুজ জহুর সেতু” নামকরণ করা হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার মনে আছে এই নামকরণ নিয়ে সেসময় পুরো এলাকাবাসী যখন তাদের প্রিয় নেতা আব্দুজ জহুর সাহেবের স্মৃতিকে স্মরণ করে তার নামে সেতুর নাম রাখতে চেয়েছিল, সেদিন আপনি সব শুনে ও দেখে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। আব্দুজ জহুর সাহেবের ছেলে জুনেদ আহমদ সেদিন আপনার কাছে এলাকাবাসীর চাওয়া তুলে ধরেছিলেন এবং সেদিন সারাদিন আপনার অফিসে বর্তমান এমপি পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এবং আমিও ছিলাম। আপনি যখন গাড়ি থেকে নেমে আসছিলেন, আপনার গতি ও প্রানবন্ত কথা আমাদের মুগ্ধ করেছিল। আপনার সদয় সম্মতিতে আজ সেতুটি আব্দুজ জহুর সেতু নামে ইতিহাস রচিত হয়েছে।
প্রিয় নেত্রী, আব্দুজ জহুর সেতু উদ্বোধনের পর থেকে সেতু এবং সেতু এলাকায় বাতি জ্বালানোর দাবি জানিয়ে আসছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে সেতু এলাকা রাতের অন্ধকারে ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। বিভিন্ন সময়ে ঘটে অনাকাক্সিক্ষত নানা ঘটনা। রাতের অন্ধকারে সেতুর উপর দিয়ে চলাচলকারী গাড়ি ও যাত্রী সাধারণ এবং পথচারীরা আতঙ্কে থাকেন। আব্দুজ জহুর সেতু রাতের বেলা অপরাধপ্রবণ এলাকায় রূপ নেয়। সেখানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আলোক সরবরাহ করা জরুরি। সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানায়, এ ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে অবগত করার পর আলোক সরবরাহের বিষয়টি সুনামগঞ্জ পৌরসভার উপর ছেড়ে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরপর সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পৌরসভাতে পাঠানো হয়। তবে সে চিঠিতে সাড়া দেয়নি পৌরসভা।
সেতুটি দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় ইতোমধ্যে তা দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ছুটির দিনসহ প্রতিদিন বিকেলের দিকে সেতুতে নারী শিশু, কিশোর-কিশোরীসহ দর্শনার্থীদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মত। সেতুর খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে ছবি তোলা, পাশের পাটাতনে বসে গল্প করার দৃশ্য নিয়মিত। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে দেখা যায় এই সকল দর্শনার্থীদের। আব্দুজ জহুর সেতুর শত ইতিবাচক দিক থাকলেও মূল সেতুর দুই পাশের এপ্রোচে র্যালিং না থাকায় ঘি ভাতে কাঁটার রূপ নিয়েছে। সেতু থেকে মুল সড়ক অনেক নিচু হওয়ায় সেতুর কিনার দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় পথচারীদের। সেতুতে আলোর কোন ব্যবস্থা না থাকায় রাতের অন্ধকারে অধিক ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় পথচারীদের। চলাচলে একটু এদিক সেদিক হলেই কিনারা থেকে ছিঁটকে অনেক নীচের সড়কে পরে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা পথচারী ও দর্শনার্থীদের। ইতোমধ্যে ছিঁটকে পরে ছোটখাটো কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনা এড়াতে সেতুতে র্যালিং না দিলে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সকলের। তাছাড়া মুল সড়কের চেয়ে সেতু অনেক উচু। সেতুকে দৃষ্টিনন্দন করতে যে খাম্বা বসানো হয়েছে সেগুলো পথচারীদের চলাচলে নিরাপত্তা বিধান করতে পারে না। তাই সেতুর দুই পাশে র্যালিং দেয়া উচিত। রাতের অন্ধকারে হাঁটার সময় ঝুঁকি নিয়ে সেতু পাড় হতে হয় পথচারিদের। সেতুতে লাইটিং ব্যবস্থা ও র্যালিং স্থাপনে বিভিন্ন মহলের দাবি উঠলেও বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না সড়ক ও জনপথ বিভাগ ।
আব্দুজ জহুর সেতুর নির্মাণ দায়িত্বে ছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেতুটির যখন ডিজাইন করা হয়, তখন সেতু এলাকায় কোনো লাইটিং কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তাই সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে লাইটিং করে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু এ সেতুটি পৌরসভা এলাকার ভেতরে পড়েছে, এটা পৌরসভা লাইটিং করলেই ভাল হয়। আবার পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, সেতু এলাকাটি পৌরসভার ভেতরে কিন্তু সেতুটি পৌরসভার নয়। এটা সড়ক ও জনপথ বিভাগের। সেতুতে বৈদ্যুতিক বাতি লাগানোর ব্যাপারে সড়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। বরাদ্দ আসলে পৌর কর্তৃপক্ষ সেতু এলাকার সড়ক আলোকিত করে দেবে। সেতু ও সেতু এলাকায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো নিয়ে দুই দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের এমন রশি টানাটানি চলছে প্রায় দুই বছর ধরে। কিন্তু বাতি জ্বালানোর দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ। আমরা চাই, এই রশি টানাটানি বাদ দিয়ে জনস্বার্থের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হোক। প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আমি এ বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।