নিরঞ্জন দাস–দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর আগের কথা। পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ি। গ্রামের ছেলে। পড়াশুনার উদ্দেশ্যে প্রথম শহর আসা। শহর সম্মন্ধে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা বালক। কতো আর বয়স। নয় কিংবা দশ। বাড়ী সদর থানাতেই। শহর থেকে মাত্র ছয়মাইল দূরে। সাফেলা গ্রাম। সেই ১৯৬৫ সালের কথা। যোগাযোগ ব্যবস্থার করুন অবস্থা ভাবা যায় না। সাফেলা গ্রাম। বলতে গেলে এখন শহরে চলে এসেছে। যে বয়সে আমি শহরে পড়তে আসি সে সময় নৌকা আর লঞ্চ ছাড়া বাড়ীর সাথে যোগাযোগের কোন বাহন ছিলোনা। নৌকায় আসলে ৪/৫ ঘন্টা আর লঞ্চে আসলে সারা দিন লেগে যেত।
সুনামগঞ্জ শহরে এসে হাজী মকবুল হোসেন পুরকাস্থ( এইচ,এম,পি) হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আস্তে আস্তে শহরের আলো বাতাসের সাথে পরিচিত হতে থাকলাম। শহরটা তেমন বড় নয়। আজকের মতো রাস্তাঘাট প্রসস্থ ছিলোনা। গাড়ী, টেম্পু, যন্ত্র চালিত তেমন কোন বাহন ছিল বলে মনে হয় না। থাকলেও হয়তো হাতেগুনা ২/১টি থাকতে পারে। মেইন সড়ক ২/১টি পাকা ছাড়া বাকী গুলো ছিলো অর্ধ পাকা কিংবা কাচা রাস্তা। বেশীর ভাগ পায়ে চলা মেঠোপথ। একমাত্র বাহন রিক্সা। মাঝেমঝে রিক্সা চলতো। তাও ছিলো হাতে গুনা কয়টি। রিক্সার টুং টাং বেলের শব্দ আমার বেশ ভাল লাগতো। অবাক হয়ে শুনতাম আর চেয়েচেয়ে দেখতাম। শহরে প্রথম স্মৃতিই ছিলো আমার রিক্সা। আর সেই রিক্সার বেলের শব্দ এতো বছর পরও কানে জীবন্ত বাজে ।
স্কুলে আমার প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় মরহুম মুহাম্মদ আব্দুল হাই। তিনি ছিলেন বিশাল মনের ও ব্যক্তিত্বের মানুষ। প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই আমি উনার ভক্ত। কিছু মানুষ আছে যাদেরকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে আসে। আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ আব্দুল হাই ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। উনার সাথে পরিচয়ের দিন থেকে শ্রদ্ধার আসনে আমি তাকে বসিয়েছি। তিনি ছিলেন অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী একজন মানুষ। তার সাথে না মিশলে। কাছ থেকে না জানলে কেউ তা বুঝবেনা। আমি তার সান্নিধ্য পেয়েছি। তাই তার পন্ডিত্যের কিছু পরিচয় পাই। তিনি ছিলেন মুক্তি যোদ্ধের অন্যতম একজন সংগঠক। বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন কলেম সৈনিক।
স্কুলের দক্ষিন প্রান্তে রাস্তার পাশে নির্দিষ্ট করা একটা রুমে স্যার বসতেন। শান্তশিষ্ট গুরু গম্ভীর চেহারা,। পরিপাটি কোকড়ানো চুল। পোষাক পরিচ্ছদে পরিপাটি । রাশভারী, মিতভাষী মানুষ। স্যারের এসব গুনাবলির কারনে হয়তো স্যারকে সবাই বেশ ভয় পেত। ক্লাস চলাকালীন সময়ে তিনি যখন বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন মনে হতো সমস্থ স্কুল নীরব হয়ে গেছে। কখনো কোন কারনে হাফ স্কুলের পর ছুটি চাইতে ছাত্ররা হেড স্যারের রুমে যেতে সাহস করত না। স্যারের ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই কিছু বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলতো।
আমি পড়াশোনায় মোটামুটি ভাল ছিলাম। তাই স্যার আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। শ্রেণীতে প্রথম হবার সুবাদে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ক্যাপটেন ছিলাম। স্যারের গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা আজো আমার কানে বাজে, তখন জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসে গ্রীষ্মের ছুটি থাকতো। স্কুলের শেষ দিন ছাত্র শিক্ষক মিলে একটা ভোজনের আয়োজন করা হতো। ছাত্রদের কাছ থেকে এক আনা, দুই আনা চাঁদা নিয়ে গ্রীষ্মের বিভিন্ন ফল এনে খাওয়া হত। আমি মুখচোরা লাজুক প্রকৃতির । সবাই খাচ্ছে কিন্ত আমি খাচ্ছিলাম না। স্যারের চোখ এড়ায়নি। আমাকে ধমক দিলেন। বললেন, তুমি খাচ্ছো না কেনো ? কেউ খাবার মুখে তুলে দেবে না। স্যারের কথাটা আজো কানে বাজে। নবম ও দশম শ্রেণীতে স্যার আমাদেরকে ইংরেজী ও ইতিহাস পড়াতেন। স্যার এর পড়ানোর পদ্ধতি এত হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয় ছিল যে শিক্ষার্থীদের বাড়ীতে এসে আর পড়ার প্রয়োজন হতো না।
ক্লাস এইটে পড়ার সময় সুনামগঞ্জ আর্টস কাউন্সিলে গান শিখার জন্য ভর্তি হলাম। স্যার তখন আর্টস কাউন্সিলের সাথে জড়িত। সম্ভবত সম্পাদকের দায়িত্বে। উস্তাদ স্বর্গীয় গোপাল দত্ত গান শিখাতেন। গানের জন্য পাঁচ টাকা ছিল মাসিক বেতন। তখন মোগই ভাই নামে একজন পিয়ন ছিলেন। আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। সন্ধ্যার সময় মাঝে মাঝে পাশের রুমে স্যারকে বসে থাকতে দেখতাম। আর্টস কাউন্সিলে আর্থিক অনটন ছিল। স্যারের পরামর্শে এস.ডি.ও. সাহেব স্থানীয় নূরজাহান সিনেমা হলে টিকেট প্রতি সারচার্জ বসিয়ে আর্থিক অনটন অনেকটা দূর করেন।
স্যার ভালো অভিনয় জানতেন। নাটকের সাথেও জড়িত ছিলেন। স্বর্গীয় ব্রম্মানন্দ দাশ স্কুলের পন্ডিত স্যার। তিনি সংস্কৃত এবং বাংলা খুব ভাল পড়াতেন। যিনি আবার মরহুম জনাব ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর সরাসরি ছাত্র ছিলেন। জনাব ড: মুহাম্মদ শহীদউল্লাহ যেদিন পরলোক গমন করেন সে দিন স্যারকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখলাম। স্যার সেদিন জনাব শহীদুল্লাহ সম্পর্কে অনেক অজানা কাহিনী আমাদেরকে শুনালেন।
মূলত: ব্রম্মানন্দ স্যার ছিলেন অভিনয় শিল্পী। একবার আব্দুল হাই স্যারের পরামর্শে ও ব্রম্মানন্দ স্যারের নির্দেশনায় স্কুলে আমরা রাস্তার ছেলে” নাটক মঞ্চস্থ করি। নাটকটি সবার প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল। হেড স্যার ‘হাছন মেলা’ আয়োজন করেন। আমাকে দিয়ে এই মেলার এনাউন্স করাতেন, । যদিও এনাউন্সে আমার কন্ঠ ভাল ছিলনা। সে সময় সুনামগঞ্জে ভাল এনাউন্স করতেন সাব্বির আহমদ, বেলায়ত হোসেন এবং মন্টুদা। আমার মনে আছে সেই হাছন মেলায় তখন আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত কন্ঠ শিল্পী প্রয়াত আব্দুল জব্বার ও মোস্তফা জামান আব্বাসী।
একবার স্যারকে নিয়ে আমরা সিরাজদ্দোল্লা নাটক মঞ্চস্থ করি। স্যার নিজে সিরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ব্রম্মানন্দ স্যার ছিলেন জগৎশেঠ এবং সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয়ে ছিলাম আমি। তখন একটি দু:খজনক ঘটনা ঘটে,, সিরাজকে যখন মোহাম্মদী বেগ হত্যা করবে সৈনিক হিসাবে আমার কাজ ছিল ধাক্কা দিয়ে সিরাজকে মঞ্চে প্রবেশ করানো,। আমার ধাক্কা দেয়াটা বেশ জোরে হয়ে যায় এজন্য স্যার বেশ ব্যথা পান। সে কথা মনে হলে আজো তা আমাকে কষ্ট দেয়।
আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন জনাব নজির হোসেন। পরবর্তীতে তিনি মহান জাতীয় সংসদের সাংসদ নির্বাচিত হন। নজির হোসেন স্যারের পরিচালনায় একবার স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা অনুষ্টিত হয়। তা ছিল স্মরনীয়। সুরমা, কুশিয়ার্,পদ্ম, মেঘনা নামে সমস্ত ক্রীড়া প্রতিযোগীকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। মাঠের চারকোনে চারটি তাবু খাটিয়ে গ্রুপের ক্যাম্প তৈরী করে দেয়া হয়। একে এক জন স্যারকে এক একটি ক্যাম্পের ইনচার্জ বানানো হয়। নজির স্যারের নেতৃত্বে খুব সুশৃংখল ভাবে সে প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক গুলি ইভেন্ট ছিল। তার মধ্যে “যেমন খুশী তেমন সাজো” ইভেন্টে নজির স্যারের তাঁবুর মাসুক ভিক্ষুক সাজে। তাকে এমন ভাবে ভিক্ষুকের মেকআপ দেয়া হয় কেউ ভুলেও বুঝতে পারেনি আসল না নকল। মাসুক ফকির সেজে সারা মাঠে ভিক্ষা করে। কেউ তাকে চিনতে পারেনি।, হেড স্যার ঠিকই চিনে ফেলেন। মাসুক এই ইভেন্টে প্রথম হয়। স্যারের পর্যবেক্ষন ছিল তীক্ষ্ণ।
১৯৭১ইং সনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় স্যারের সাথে আমার দেখা হয় বালাট। রনাঙ্গনের খবরা খবর পাঠাতেন আকাশবাণী, কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকা, জয়বাংলা সহ বিভিন্ন মিডিয়ায়। যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে সাইকেল নিয়ে ঘুরতেন সীমান্তের এপ্রান্ত থেকে অপ্রান্তে। স্যার পরিবার নিয়ে থাকতেন টিলার উপর সিএনবির একটি বিল্ডিং এ। মরহুম জনাব দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরীর ও থাকতেন একই টিলার একটি ঘরে। স্যার আমাকে উনার দু’মেয়ে নিপা ও দীপাকে পড়াতে বলেন। গৃহ শিক্ষক হয়ে স্যারের ঘরে ডুকে আমিতো অবাক। ঘর ভর্তি শুধু বই আর বই। কি ভাবে যে এতগুলি বই নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিলেন ভেবে পাইনা। সে সময় অনেক গুলি বই স্যার আমাকে পড়তে দেন। এর মধ্যে কিছু বই পাকিস্তান সরকার কতৃক নিষিদ্ধ ছিলো। স্যারের সাথে সে সময় আরেকটু ঘনিষ্টতা বাড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্যারের আরপিন নগরের বাসায়ও অনেক দিন নিপা ও দীপাকে আমি পড়িয়েছি। স্যারের ছেলে গালিব ছিল তখন অনেক ছোট। সে ও কোনকোন সময় বই নিয়ে পড়তে বসতো।
১৯৭৩ইং সনে স্যার স্কুলের চাকুরী ছেড়ে ইলেকশনে সুনামগন্জ পৌরসভায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্যারের জন্য আমি ও রাখাল স্যার নুতন পাড়া,,হাছন নগর সহ অনেক পরিচিত বাসায় ভোটের প্রচারনা করি। ১৯৭৬ ইং সনে আমি সিলেট পলিটেকনিকেলে পড়তে যাই। স্যারের সাথে সিলেটে দেখা হয়। স্যার নিজের রচিত ‘হাছন পছন্দ’” বইটি আমাকে উপহার দেন। বই থেকে কিছু গান গাওয়ার জন্য বলেন । দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আজ এই মূল্যবান বইটি হারিয়ে ফেলেছি। স্যারের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আজ এত বছর পর গুরুগম্ভীর মুখ। পরিপাটি চুল। বইয়ের সেলফ। সব চোখে ভাসে । শুধু স্যার নেই। এই পন্ডিত মহান মুক্তি যোদ্ধাকে জানাই শতকোটি সালাম। নতুন প্রজন্মদের কাছে আজ তাঁর আদর্শ।, কর্মগুলি তুলে ধরা দরকার। তার আদর্শ সারা জীবিন অনুকরনিয় হয়ে থাকবে । স্যারের আত্মার শান্তি কামনা করি। পরপারে ভাল থাকুন স্যার।
লেখকঃ–নিরন্জন দাশ। বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক প্রকৌশলী শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রকৌশলী এ,ডি,এম কনস্ট্রাকশন কোম্পানী নিউ ইয়র্ক। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
২১১ বার