এস এম নাদিম মাহমুদ ::ডেভিড বার্গম্যান গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমালোচিত। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কাজ করার প্রেক্ষিতে তাদের কৃতকর্ম শুধু সমালোচিতই নয়, নিন্দিত বটে। ২০১৪ সালে বিবিসি, গার্ডিয়ান, ডনসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকার খবরে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩ থেকে ৫ লাখ। বার্গম্যানের কথিত ব্লগের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই তথ্য সরবরাহের জন্য তাকে সাজা পেতে হয়। অবশ্য সে সাজা পাওয়ার ঘটনায় আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরাসরি বিরোধিতাকারি এই বার্গমানকে পুঁজি করে সম্প্রতি আল-জাজিরা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে। দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক পরিচয় দিয়ে বার্গমানের প্লটকে সামনে এনেছে আল-জাজিরা। বাংলাদেশ ব্যতিত আর কোন দেশ নিয়ে তার মাথাব্যথা আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ। আর সেই কারণে, দেশের মিডিয়া ছেড়ে তিনি আর তাসনিম খলিল ‘নেত্র নিউজ’ নামে একটি পোর্টাল খুলেছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই প্রতিবেদনটিতে যাদের খুশি হওয়ার কথা তারা হয়েছে। ‘পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ওয়েব পোর্টাল ‘পাকিস্তান ডিফেন্স’ আল-জাজিরার এই প্রতিবেদন শেয়ার করে বেশ কিছু মন্তব্য তুলে ধরেছে। ফলে পরিকল্পিত প্রতিবেদনের স্বাদ আপাতত তারা পেয়েছে।

সেনাপ্রধান ভাল না মন্দ সেটি বিচার আমি করছি না। তবে তার ভাইয়েরা সন্ত্রাসী, দাগী অপরাধী তা বাংলাদেশের কম বেশি সবাই জানে। নব্বই দশকের পত্রিকাগুলো আপাতত সেটাই প্রমাণ করে। নৈতিক দিক থেকে এই প্রতিবেদনের অনেক চিত্রই সেনাপ্রধান হিসেবে মানায় না, এটা যেমন সত্য তেমনি, প্রতিবেদনে কিছু অসংলগ্নতার আশ্রয় নেয়া হয়েছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এই প্রতিবেদনে হাঙ্গেরিতে বসবাসরত স্যামি নামের একজনের বক্তব্য ও তথ্যের উপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে। এই প্রতিবেদনে অনেক ডকুমেন্ট শো করা হয়েছে, স্বাক্ষর থেকে শুরু করে ডিটেইলস ইমেইলের স্ক্রিনও শেয়ার হয়েছে। তবে মজার বিষয় হলো, স্যামির সাথে সেনাপ্রধানের যে ইমেইল চালাচালি হয়েছে, তার স্ক্রিন শেয়ার করা হয়নি। বরং মেইলের কিছু বাক্য তুলে দেয়া হয়েছে সেনাপ্রধানের নামে। এইসব ইমেইলে কী কথাবার্তা হয়েছে? কেন সেইসব মেইলের সবকিছু শেয়ার করা হলো না?

স্যামি বলছে, ২০১৬ সালে তিনি জানতে পারেন, মি. আজিজের ভাই হারিস আহমেদ ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড ম্যান। তার মনে হয়েছে, আজিজ ও হারিস তাকে ব্যবহার করছে। আর এরপর সে হারিসের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করার চেষ্টা করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। যেকারণে, তাকে সেনাপ্রধান হুমকি দেন।

শুরুতে যে ইমেইলের বাক্য শেয়ার করা হলো তা হচ্ছে, ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল। সেখানে বলা হয়েছে, You committed sort out all problem of hasan your sudden silence gives a different smell. ঠিক কী প্রেক্ষিতে সেনাপ্রধান স্যামিকে এই বাক্য লিখলেন? আপনি যখন কোন কথোপকথনের কিয়ৎ অংশ তুলে ধরবেন, তখন এর ভিতরে থাকবে অন্ধকার। তাই এই বাক্য নিয়ে সংশয় থাকা অমূলক হবে না। এরপর স্যামি বলছে, তাকে হুমকি দিয়েছে সেনাপ্রধান। তার ভাষায়, ২০১৬ সালের ৬ মে ‘ Financial details’ সাবজেক্টে বলা হয়েছে. If my brother has to return, people responsible will repent they will course their life, I promise… সেনাপ্রধানের ভাইকে কেন দেশে ফিরে যেতে হবে আর আজিজ সাহেবই বা কেন স্যামিকে হুমকি দেবেন তা এই বাক্য দ্বারা বুঝা শুধু কঠিন নয়, বাক্যের ভিন্নতাও প্রকাশ করে। এমনকি ঘটনার অবতারণা স্যামি করেছিল, যার জন্য সেনাপ্রধান এই বাক্যে ইমেইল করেছিলেন? ধরলাম, স্যামি কোনভাবে হারিসের সাথে প্রতারণা করে, তাকে দেশে ফেরানোর জন্য কিংবা তার গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে তৃতীয় কোন মাধ্যমকে। আর এই প্রেক্ষিতে কি সেনাপ্রধান তাকে এই হুমকি দিলেন?

একজন মানুষকে যদি হুমকি দেওয়া হয়, তাহলে একই প্রতিবেদনে ১০ মাস পর ২০১৭ সালের ১১ মার্চ ইমেইল বার্তায় সেই হুমকিদাতা বা কেন তাকে ব্যবসা করার অফার দিলো? সেই ইমেইলকে উদ্ধৃতি দিয়ে আল-জাজিরা বলছে, If you ask me, I will take the nesceassary step accordingly. ঠিক কী বিষয়ে কথা বলছে তা পরিস্কার হয়নি। বরং, ইমেইলটি ভিন্ন ইঙ্গিত বহন করে।

এই ইমেইলের প্রায় দুই মাস পর ২০১৭ সালের ১৩ মে ইমেইলে বলা হচ্ছে, You can send proposal for small investment, I will consider… যদি বলা হয়, বে-অব-বেঙ্গলের হাত ধরে স্যামি কোন অনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য মি. আজিজের কাছে আপ্রোচ করে, তাহলে সেটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? সেনাপ্রধান তাকে হুমকি দিলেন, সে সিদ্ধান্ত নিলো, আজিজ ও তার ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে থাকবে, তাহলে এক বছর পর কিসের লেনাদেনা চলছিল?

এই ঘটনার দুই বছর পর এই স্যামি আল-জাজিরার হয়ে কাজ শুরু করলো ২০১৯ সালে। যদি আল-জাজিরার হয়ে কাজ শুরু করে, তাহলে হারিসের সাথে কথিত ডিজিএফআই (১৫ মিনিট ১৪ সেকেন্ডে) হাঙ্গেরি থেকে কোন একটা কিছু সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করার গোপন ভিডিও কেন ধারণ করলো? ২০১৬ সালই যদি স্যামির মনে হয়, হারিস সন্ত্রাসী লিস্টের টপ মোস্ট ওয়ান্টেড, তাহলে ঠিক কারণে, এদের কাছে থেকে সরে যেতে পারেনি? এরপর সে প্রি-ডিটারমাইন্ড হয়ে গোপনে ভিডিও করেছে, গুছিয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন করেছে, সেইসবের উত্তর বের করেছে এবং তা আল-জাজিরায় সরবরাহ করেছে। শুধু সরবরাহ করেননি, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার দুর্বলতাও স্পষ্ট করেছে।

হাঙ্গেরিতে অনেক বাঙালি আছে। দূতাবাস না থাকলেও এখানে চাকুরি ও পড়াশুনার জন্য অনেক প্রবাসী রয়েছে। ঠিক এতো বাঙালি থাকতে, সেনাপ্রধান কেন স্যামির সাথে পরিচিত হতে গেলেন তা-পরিস্কার তো হয়নি। স্যামির এমন কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা পরিচিতির জন্য সেনাপ্রধান তাকেই কাছে টানলেন, তা জানা যায়নি। যদি বলা হয়, আল-জাজিরায় টোপ হিসেবে স্যামিকে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন?

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে পিকসিক্স নামের ডিভাইস ব্যবহারের ফলে বিভিন্নজনের মোবাইলের কথোপকথন রেকডিং করা হচ্ছে। ইসরাইলে ডিভাইস বাংলাদেশ কিনতে পারে না বলেও যুক্তি দেখানো হচ্ছে। আচ্ছা, আপনাদের প্রতিবেদনেই সেনাপ্রধানের মোবাইল ফোনের কথা রেকডিং করে প্রচার করলেন, সেটা কোন ডিভাইসের সহায়তা নিয়ে? এটা কতটা নৈতিক ছিল?

বুঝলাম, সাংবাদিকতায় সেটি করা যায়। তাহলে দেশের বিভিন্ন জায়গা বোমা হামলা, অস্ত্র পাচার, ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে একটি রাষ্ট্র কি প্রযুক্তির সহায়তা নিতে পারে না? পৃথিবীর অনেক দেশই যে করে, সেই খবর তারা কি জানে? প্রশ্ন হলো, এই ডিভাইস ইসরায়েলের যদি হয়েও থাকে তাহলে হাঙ্গেরিতে প্রস্তুত করা জিনিস বাংলাদেশ কিনতে পারে না?

যদি আমরা মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলি, সেটা ঠিক আছে। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, দেশের শান্তি রক্ষার্থে এই ধরনের প্রযুক্তি আমাদের আশীর্বাদ হতে পারে। সেটিকে মিসকনস্পেটচুয়ালি উপস্থাপন এক ধরনের প্রিটেন্ট চিন্তার ফসল।

আমরা এমনিতে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। গণতন্ত্রকে সুরক্ষা নিয়ে অনেকের মনে সংশয় আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সেনাপ্রধান যদি তার ভাইদের অবৈধ সুযোগ দিয়ে থাকেন তাহলে সেই অপরাধের দায় তাকে নিতে হবে। তবে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান বলে চালিয়ে দেয়া কতটা মানানসই তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। পুরাতন একটা ছবি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত লোক দাবি করার ভিত্তিও খুঁজে পাইনি।

কয়েক বছর আগে, কাতারভিত্তিক এই সংবাদমাধ্যম দেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের একটি বিতর্কিত সাক্ষাৎকার তুলেছিল, যা পরবর্তীতে গণমাধ্যমে সমালোচিত হয়েছে। আমরা বলছি না, দেশে দুর্নীতি নেই, কিংবা সেনাপ্রধানের ভাইয়েরা অপরাধী নয়, যেসব তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে, তার হয়তো ভিত্তি থাকলেও থাকতেও পারে। তবে আপাতত দৃষ্টিতে প্রতিবেদনটি নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। একপাক্ষিক বক্তব্যে তুলে নানার বিতর্কের জন্ম দেওয়া হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব।sunamganjbarta.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়েsunamganjbarta.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn