আওয়ামী লীগ ও কওমি শিক্ষা বোর্ডজামায়াতবিরোধী ধর্মভিত্তিক ছোট-ছোট দল ও কওমিপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক-উন্নয়ন শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতিও দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণ ইস্যুতে হেফাজতসহ ইসলামি দল ও সংগঠনগুলোর দাবির প্রতি মৌন-সমর্থনও দিয়েছে। বিষয়টিকে সরকারের নির্বাচনি কৌশল হিসেবে দেখছেন রাজনীতিবিদরা। আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ধর্মভিত্তিক ছোট দল-সংঠনগুলোর প্রায় এক কোটি ভোট কাছে টানতেই আগামী নির্বাচনের পৌনে দুই বছর আগেই কওমিপন্থীদের প্রতি নমনীয় ভাব দেখাচ্ছে সরকার। তাদের মতে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মনে করছে, জামায়াতবিরোধী এসব ধর্মভিত্তিক দল-সংগঠনকে রাজি-খুশি রাখতে পারলে ২০১৯ সালের নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া  জন্য সহজ হবে।

জানা গেছে, কওমির মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীসহ কওমিপন্থী প্রায় ১ কোটি ভোটারের হিসাব কষছে আওয়ামী লীগ। কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামি শিক্ষার প্রতি আওয়ামী লীগের ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রমাণ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ভোটও আশা করছে।  নতুন এই ভোটগুলো এলে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের জন্য সুফল নিয়ে আসবে।

আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী সূত্রগুলো মনে করে, হেফাজতকে এই মুহূর্তে সঙ্গে রাখলে শেষ পর্যন্ত তারা পক্ষে না থাকুক,  বিপক্ষেও যেতে পারবে না। সেটা হবে আওয়ামী লীগের জন্যে এক ধরনের সফলতা। দলটির নেতারা মনে করছেন, হেফাজতসহ কওমিপন্থী বৃহৎ এ গোষ্ঠী নির্বাচনের আগে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিএনপির দিকে ঝুঁকে গেলে তাতে নানা সংকট দেখা দিতে পারে।

আওয়ামী লীগ মনে করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৯ সালের নির্বাচন কোনও মতেই তারা বর্জন করবে না। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে কোনও ধরনের সমাঝোতা না হলেও বিএনপি নির্বাচনে আসবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তাদের মতে, বিএনপি নির্বাচনে এলে তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। বিষয়টি তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাসও করেন। কাজেই বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে গেলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে ভোটের অঙ্ক নিয়ে ভাবতে হবে। আর এই ভাবনার অংশই হচ্ছে কওমিপন্থীদের কাছে ডাকা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্পাদকমণ্ডলীর একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোলামেলাই বলেন, আগামী নির্বচানকে মাথায় রেখেই হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক-উন্নয়ন। আর কওমি সনদের স্বীকৃতির মূলেই রয়েছে সরকারের হিসাব-নিকাশ। তাহলো এই গোষ্ঠীর অন্তত এক কোটি ভোট রয়েছে। তাদের নার্সিং করা গেলে ভোটের রাজনীতিতে একটি সুফল আমাদের পক্ষে আসবে।’ ওই নেতা বলেন, ‘প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই ভোটের হিসাব মাথায় থাকে। আওয়ামী লীগও এর বাইরে নয়।’

ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর অন্তত এক ডজন নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হেফাজত নিয়ে সরকারের যে অবস্থান, তা একেবারেই কৌশলী। সরকারের গৃহীত এ কৌশলের সঙ্গে  দ্বিমত নেই দলের। তারা বলছেন, হেফাজতসহ কওমিপন্থীদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাখলে, তারা শেষ পর্যন্ত পক্ষে না থাকুক,  বিপক্ষে গিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে পারবে না। নির্বাচন পর্যন্ত সরকারের জন্য এ কৌশল গুরুত্বপূর্ণ। যা সরকারের জন্য এ মুহূর্তে প্রয়োজন।’

দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে হেফাজতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কৌশলগত বলে দাবি করেন।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বা ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে কথা বলা হয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে, হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে মূল্যায়নের অনেক সময় পড়ে রয়েছে।’ সরকারের হেফাজত সখ্য নিয়ে আওয়ামী লীগকে ইতোমধ্যে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকরা মনে করে, ‘ইস্যুটি স্পর্শকাতর। এক্ষেত্রে হেফাজতকে কাছে রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত বন্ধুদের হারানো যাবে না।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘কওমি সনদের স্বীকৃতি দেশের ভেতরে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। সরকারও কওমি শিক্ষার্থীদের স্বীকৃতি দিয়ে ওই জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনতে চায়। এতে অসুবিধা কোথায়?’ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী  বলেন, ‘হেফাজত বা কওমিদের স্বীকৃতি নিয়ে এখনই এত সমালোচনা কেন?’ তিনি বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মূলধারায় নিয়ে আসতে পারলে অসুবিধা কোথায়? সরকার তো শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নয়, ১৬ কোটি মানুষেরও। তাদেরও দেখার দায়িত্ব সরকারের।’

সভাপতিমণ্ডলীর  আরেক সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম  বলেন, ‘কওমিকে স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হেফাজতের সঙ্গে সখ্য নয়, একটি গণদাবি বিবেচনায় নিয়ে সরকার কেবল স্বীকৃতি দিয়েছে। এর বাইরে আর কিছুই নয়।’ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ  বলেন, ‘কওমি ও হেফাজত নিয়ে এত আলোচনার কোনও অর্থ নেই। কওমি শিক্ষার্থীরা তো এদেশেরই জনগণ।’ তাদের মূলধারায় নিয়ে এলে জঙ্গি প্রতিরোধেও  বিষয়টি সহায়ক পদক্ষেপ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn