দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নীতি ও কৌশলে হঠাৎ ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে তাদের রাজনীতির কৌশলও। কয়েক মাস আগেও যেখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা ইসলামপন্থীদের জঙ্গি আখ্যায়িত করে গালমন্দ করতেন সেখানে ওই ইসলামপন্থীদেরই কাছে টেনে নিয়েছে তারা। অন্যদিকে কয়েক মাস আগেও যেখানে বিদেশিদের ওপর বিশেষ করে ভারত তোষণনীতিতে নির্ভরশীলতার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল বিএনপি সেখানে আজ অনেকটাই দূরে সরে এসেছে। ক্রমেই দেশের জনগণের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। এমনটিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে। প্রধান দুই দলের হঠাৎ এমন বৈপ্লবিক পরিবতর্নের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, এমন প্রশ্নই এখন সবার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ আওয়ামী লীগের নীতিতে এমন পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, দেশের বাস্তবতা মানতে হবে। দেশের সিংহভাগ মানুষের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশে হাইকোর্ট ভবনের সামনে থেকে একটি ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার প্রকাশ্য সমর্থন নিয়ে অব্যাহত বিতর্কের মাঝেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমন বক্তব্য দিলেন। ১১ এপ্রিল এক বৈঠকে হেফাজতের নেতারা ইসলামি সংস্কৃতির সাথে সাংঘার্ষিক এই যুক্তিতে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়ার দাবী তুললে শেখ হাসিনা বলেন- তিনি নিজেও এটি পছন্দ করেন না।
তারপর থেকেই টিভি-সংবাদপত্র সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই সমালোচনা করছেন-রাজনীতির স্বার্থে আওয়ামী লীগ হেফাজতকে অতিরিক্ত ছাড় দিচ্ছে, আপোষ করছে । এর ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন,এ বিষয়ে প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত থাকতে পারে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা বলেননি। তিনি(প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতির সাথে বসবো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর্যটি সম্পর্কে বলেছেন তিনি নিজেও এটি পছন্দ করেননি। এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের আবারো বলেন, ‘সেটা বলেছেন। কিন্তু তিনি এটাও বলেছেন যে, তিনি প্রধান বিচারপতির সাথে আলাপ করবেন। কোনও চূড়ান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’ তবে শুধুমাত্র ভাস্কর্য ইস্যুটিই নয়। হেফাজতে ইসলামীর দাবির প্রেক্ষাপটে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এসেছে, কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রীকে মাস্টার্স হিসেবে যোগ্যতা দেয়ার বিষয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে সরকার খুব জোর গলায় অভিযোগ করেছে তা নয়। এ বিষয়টাকে সরকারের কম্প্রোমাইজ হিসেবে দেখছে সবাই। তবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কাদের বলেন, ‘কম্প্রোমাইজ কেন হবে? দেখুন এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদেরর বিচার কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এ দুঃসাহসিক কাজটা শেখ হাসিনার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। জঙ্গি-বিরোধী অবস্থান এটা নিয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। তবে আমাদের দেশে কিছু রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে।’
তিনি বলেন, ‘অনুভূতি -আবেগ আছে। আমাদের মডারেট হতে হবে। বাস্তবতার আলোকে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের দেশে জনগণের আবেগ-অনুভূতির দিকটা আমাদের দেখতে হবে।’ এটা আপোষ নয়, মাদ্রাসা শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেওয়ার লক্ষ্য বলে তিনি উল্লেখ করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে আসছে আওয়ামী লীগের সরকার। সেখানে ইসলামী একটি গোষ্ঠীর দাবির প্রতি সমর্থন দেয়া কি নিজেদের মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসা নয়? জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘রিয়েলিস্টিক অ্যাপ্রোচ নিয়ে দেশ চালাতে হবে। অধিকাংশ জনগণের যে আবেগ-অনুভূতি সেটাকে ইগনোর (উপেক্ষা) করতে পারিনা।’ এরপর যদি অন্য কোনো ভাস্কর্য সরানোর দাবি তোলা হয় তখন কি করবে সরকার? এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সেটা হলে তো আমরা মানবো না।’ তবে আওয়ামী লীগের নীতি-কৌশলে হঠাৎ এই পরিবর্তনের পেছনে বড় ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে বলেই মনে করেন অনেকে। সবচেয়ে যে বড় স্বার্থ সামনে রেখে আ.লীগ হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতায় গেছে সেটা হচ্ছে- আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামপন্থী ভোটারদের কাছে টানা। এক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলাম একটা বড় ফ্যাক্টর।তাদের একটা ভোট ব্যাংক রয়েছে বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা।

অন্যদিকে বছর খানেক আগেও বিএনপির ধারণা ছিল- বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে ভারতসহ বিশ্বের পরাশক্তিধররাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের বিষয়ে তাদের নীতি পাল্টাবে। কিন্তু তাদের সে ধারণার প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে বিএনপি তাদের রাজনীতিতে হঠাৎ বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।এরই অংশ হিসেবে তারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পথচলার কথা ভাবছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, জনগণই মূল ক্ষমতার উৎস, এটা ভুলে গেলে চলবে না। কোনো কিছু করতে হলে জনগণকেই সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। বিএনপির বিদেশনীতিতে কী বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন এনেছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সবার সঙ্গে সহাবস্থান ও সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানে বিএনপি সর্বদা বিশ্বাসী। ফলে সে অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং কখনো হবে না। তবে যারা আগ্রাসন বিস্তার করতে চায় তাদের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান আরো সুদৃঢ় মনোভাব। কোনো মতেই এদেশে কারো আগ্রাসন চালাতে দিবে বিএনপি।

মাহবুবুর রহমানের এই বক্তব্যে প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিএনপির অন্য শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যেও। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ১২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সম্পর্কে কথা বলেছেন, বিশেষ করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারতের তত্কালীন সরকার (কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার) ‘ন্যক্কারজনকভাবে হস্তক্ষেপ’ করেছিল বলে খালেদা জিয়া সরাসরি অভিযোগ করেছেন। খালেদা জিয়া জরুরি সংবাদ সম্মেলনটি ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য। তবে সংবাদ সম্মেলনে রাখা বিএনপি চেয়ারপারসনের লিখিত বক্তব্যের বেশিরভাগ জুড়েই ছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এবং বর্তমানেও ভারত সরকারের ভূমিকা কেন্দ্রিক। লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেছেন ‘২০১৪ সালে কলঙ্কিত ও প্রহসনের নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতের তদানীন্তন সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে খুবই ন্যক্কারজনকভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব (সুজাতা সিং) বাংলাদেশ সফরে এসে ক্ষমতাসীনদের প্রহসনের নির্বাচনের নীল-নকশা বাস্তবায়নে প্রকাশ্যে ভূমিকা পালন করেছিলেন। সে কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ভারতের বিগত সরকারই আওয়ামী বলয়ের শাসন ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার ক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা করেছে এবং তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থনেই এদেশের জনবিচ্ছিন্ন সরকার ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। ফলে ভারতের অবস্থান এখনো বদলায়নি।

এদিক বিবেচনায় বিএনপি ভারতনীতিতে তাদের অবস্থান অনেকটাই বদলে দিচ্ছেন। নব্বইয়ের দশকে বিএনপি ভারতবিরোধী ভূমিকা নিয়ে যে ধরনের লাভবান হয়েছিল তারা সেটা এখন অনেকটাই পুনর্মূল্যায়ন করছেন।কারণ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ভারতের আগ্রাসন সম্পর্কে সচেতন, আগে থেকেই তারা ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করে আসছে বলে ধরে নেয়া হয়। ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর এ মনোভাবকে কাজে লাগাতে বিএনপি ফের তাদের আগের অবস্থানেই ফিরছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতাও দলটির চিন্তার সত্যতা স্বীকার করেন। তাদের মতে, এদেশে বড় কোনো পরিবর্তন আনতে হলে জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়েই আনতে হবে। ফলে শুধু বিএনপি নয়, সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন অন্যান্য দলের নেতারাও। অনেক বুদ্ধিজীবী এমন মনোভাব পোষণ করেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn