ইতিহাসের প্রতিশোধ, হাসিনার হাতে বিএনপির রাজনীতি ডিফিকাল্ট
শনিবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইতিহাসের রেকর্ড ভঙ্গ করা বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় সভানেত্রী হিসেবে নয়, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, দেশ এগিয়েছে। দেশ এগিয়ে যাবে। এই নিয়ে টানা তৃতীয়বার ও সর্বমোট চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের পর বিজয়-উত্তর আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য জনসমুদ্রে তিনি পরিষ্কার চারটি যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। যার তিনটি যুদ্ধ তিনি আগেই শুরু করেছেন। তা হচ্ছে- সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই চলমান তিন যুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রশ্নে তিনি শতভাগ সাফল্যের মুকুট পরেছেন। এবার তাঁর যুদ্ধ হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। যে দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রায় ৫০ বছরে বাসা বেঁধেছে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও মাদকের চেয়েও এ যুদ্ধ কঠিন যুদ্ধ।
দুর্নীতি উপর থেকে তৃণমূলে শিকড় গেড়েছে। নানামুখী পথ ধরে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতির ডালপালা বিস্তৃত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের ওয়ার্কিং কমিটি থেকে টিমওয়ার্কের ভিত্তিতে নেতা-কর্মীরা তৃণমূল থেকে দলকে যেভাবে জাগিয়েছিলেন, সংগঠিত করেছিলেন, তাতে নির্বাচনে গণজাগরণ ঘটিয়ে বিশাল বিজয় নিয়ে এসেছেন। মালয়েশিয়ার সফল নেতা মাহাথির মোহাম্মদ তাঁর দেশে গণতন্ত্র কতটা দিতে পেরেছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে যে সফল হয়েছেন, তা তাঁর শত্রুও স্বীকার করবে, ভুল করবে না। বাংলাদেশেও নব্বই-উত্তর গণতন্ত্রের নবযাত্রায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় সরকারের পালাবদল ঘটলেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া গেছে, এ কথা কেউ যেমন হলফ করে বলতে পারবে না, তেমনি দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে নেওয়া হয়েছে, তাও বলা যাবে না। ২০০১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিরোধী দলের ওপর দমন-নির্যাতন, দুর্নীতির মহোৎসব, একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা এমনকি একুশের গ্রেনেড হামলার মতো প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে দিনদুপুরে শান্তিসমাবেশ থেকে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাসহ তাঁর দলের নেতাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্লজ্জ চেষ্টা বিশ্ববিবেককে যেমন নাড়া দিয়েছিল, তেমনি গোটা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল।
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার কালো হাত প্রসারিত করে গোটা দেশকে গ্রেনেড বোমা, সন্ত্রাস ও বাংলা ভাইদের উত্থান ঘটিয়ে, ১০ ট্রাক অস্ত্র পাঠিয়ে এমনকি লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত স্বাধীন দেশের মাটিতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিল। সে দিনগুলো ছিল দুঃসহ, বিভীষিকাময়। গোটা রাষ্ট্রের হৃৎপি- থেকে রক্তক্ষরণ ঘটছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত হেনে, এমনকি ক্ষমতায় আবার ফিরে আসার জন্য ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য নির্বাচন কমিশনকেই দলীয়করণ করা হয়নি, এক কোটি ভুয়া ভোটার তালিকাই করা হয়নি, নিজেদের পছন্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে চতুরতার সঙ্গে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাশাপাশি হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী তারেক রহমানকে ঘিরে প্যারালাল সরকার সৃষ্টি করা হয়েছিল।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী-নেতারা অপমান-অপদস্থ হচ্ছিলেন। বঙ্গভবন থেকে দলীয় এমপিদের কঠোর সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেই সেদিনের রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী রেহাই পাননি। বিকল্পধারা গঠন করায় তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। তাঁর সভা পন্ড করে তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। বীতশ্রদ্ধ হয়ে দল ছেড়ে দেওয়া বিএনপির মন্ত্রী-নেতাদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথমে ১৪ দল পরে মহাজোট গঠন করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ৩৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব সামনে নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেদিন বিএনপি তার দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বিরোধী দলের দাবি উপেক্ষা করে একতরফাভাবে একদলীয় নির্বাচনের পথে হেঁটে রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি তাঁকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছিল। উপদেষ্টা পরিষদ থেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখতে না পারায় ও ইয়াজউদ্দিনের পুতুলনাচের স্বেচ্ছাচারিতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছিলেন। তবু সেদিন ক্ষমতার উচ্চাভিলাষে অন্ধ বিএনপি আত্মঘাতী পথ থেকে সরে না দাঁড়িয়ে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দু-এক জন গোপাল ভাঁড়ের জন্ম দিয়ে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেছে।
অন্যদিকে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত সহিংসতার পথই নেয়নি, জনজীবন অচল হয়ে পড়েছিল। এমনি পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। সেই সরকার তিন মাসের মধ্য নির্বাচন না দিয়ে টানা দুই বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করে। দুই নেত্রীকে জেল খাটায়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর ওপর কঠোর দমননীতি চালায়। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ওপর অত্যাচারের খড়্গ নেমে আসে। কেউ কেউ কারাগারেও নিক্ষিপ্ত হন। কেউ কেউ পলাতক হয়ে দেশান্তরী হন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করা হয়। অনেকের কপালে ঢালাও দুর্নীতির মামলা থেকে মদের মামলাও দেওয়া হয়। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আসা ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজে উগ্র, হঠকারী বেপরোয়া শাসনের ফলে। অন্যদিকে সরকারের শুরুতেই রাজনৈতিক সংস্কারের নামে অরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নির্বাচনের দাবিতে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। দেশের বাইরে বিদেশ থেকে তাঁর দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও সাহসিকতার সঙ্গে আপসহীন চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশেই ফেরেননি, তাঁর অবস্থানে অটল থাকেন। এজন্য কারাগারে নিয়েও তাঁকে বা তাঁর দল আওয়ামী লীগকে নত করা যায়নি।
২০০৮ সালে স্বচ্ছ ভোটার তালিকার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে হয় মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারকে। আর সেই নির্বাচনে বিশাল গণরায় নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। বিশ্বমোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর যুদ্ধাপরাধীদের একদিকে যেমন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে আটকে রাখা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার সম্পন্ন করে খুনিদের ফাঁসিতে ঝোলান। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন থেকে বাতিলই হয়নি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকেও গণজাগরণে সম্পৃক্ত করেন। দেশের বিদ্যুৎ, যোগাযোগব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটান।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াতের সহিংস বর্জন কর্মসূচিকে মোকাবিলা করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যান। সংবিধানের দোহাই দিয়ে পাঁচ বছর নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের রাজনীতিকে হরতাল-অবরোধমুক্তই করেননি, দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে একদিকে যেমন জেলে পাঠান, তেমনি অন্যদিকে তাঁর পুত্র তারেক রহমান একুশের গ্রেনেড হামলার বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন দণ্ডে দন্ডিত হন। বিএনপি-জামায়াতের পাপের শাসনামলে অপশাসনের অপরাধে আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের রাজনৈতিক কোমরটি ভেঙে দেওয়া হয়। অন্যদিকে যুগের পর যুগ ঝুলে থাকা সীমান্ত সমস্যার সমাধান করেন। দেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নিয়ে যান। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে অসত্য প্রমাণ করে তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্পের কাজ সমাপ্তির দিকে নিয়ে যান। দেশকে সার্বিক উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞে দৃশ্যমান করেন। সব দলের অংশগ্রহণে দলীয় সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতেও সফল হন।
ভোটের ফলাফল নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন পরাজিত শক্তি বিএনপি ও তাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। তাঁরা এই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবি তুললেও সরকারপক্ষ এটাকে মামাবাড়ির আবদার বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। শেখ হাসিনার সরকারকে আন্তর্জাতিক মহল অভিনন্দন জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ যেখানে এই নির্বাচনী বিজয় নিয়ে বিজয়ের মহাসমাবেশ বর্ণাঢ্যরূপে শেষ করেছে। বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সেখানে নির্বাচন ঘিরে তাদের যত অভিযোগ ও বক্তব্য তা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি প্রতিবাদ বা বৃহৎ জনসমাবেশও করতে পারেনি। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আইনি লড়াইয়ের কথা বলছে, কূটনীতিকদের ব্রিফ করছে আর সংবাদ সম্মেলন করছে। অন্যদিকে জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচন করার কারণে ভুল স্বীকার করছে। আরেকদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল শক্তি বা আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম নেতৃত্বহীন বিএনপিতে নেতৃত্বের ব্যর্থতার অভিযোগ নেতারা তুলছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সকল পর্যায়ের নেতাকে কারাগারে নিক্ষিপ্তই করা হয়নি, সেনাশাসকরা নির্দয়ভাবে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করেছিল। সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে মার্শাল ল ডিক্টেটর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্পই নেননি, দলকে ভেঙে দেওয়ার প্রয়াসও চালিয়েছিলেন।
আজ যে বিএনপি মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে কথা বলছে, সেই বিএনপির জন্মদাতা সেনাশাসক জিয়া মার্শাল ল ডিক্টেটর হিসেবে প্রথমে প্রহসনের তুঘলকি ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোট করে ভোটার ছাড়াই নিজের অসাংবিধানিক অবৈধ শাসনকে পাকাপোক্ত করতে হ্যাঁর বাক্স ব্যালটে ভর্তি করেছিলেন। সেনাশাসক হিসেবে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর দক্ষিণপন্থি মুসলিম লীগ ও মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী চীনের অনুসারী অতিবিপ্লবী চীনাপন্থিদের নিয়ে আওয়ামী লীগবিদ্বেষী বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেনাশাসক হিসেবে ’৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে প্রহসনের ভোটে নিজেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিলেন। ’৭৯ সালে সেনাশাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে জামায়াতকে পুনর্বাসিত করে আইডিএলের মাওলানা রহিমের নেতৃত্বে পাকিস্তানপন্থি দলগুলোকে সংসদে এনেছিলেন। সেনাশাসক হিসেবে গঠিত বিএনপিকে বন্দুকের জোরে দুই-তৃতীয়াংশ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের মতো তৃণমূল বিস্তৃত জনপ্রিয় দল, যে দলটি স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের একচ্ছত্র প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, সেই দলকে মাত্র ৩৯টি আসন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সেদিন দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক নির্বাচন করেননি। দলের অনেক নেতাকে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছিল। সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারে অনেককে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। দলের সভাপতি আবদুল মালেক উকিলকে বিজয়ী হতে দেওয়া হয়নি। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদের গণরায় ছিনতাই করা হয়েছিল। সারা দেশে নির্বাচন কমিশন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়েছিল।
একালের অনেক চিন্তাশীল তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের টকশোয় স্বাধীন দেশের প্রথম ফৌজিশাসক জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নায়ক বলে মাথার তাজ বানিয়ে গণতন্ত্র ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তত্ত্বের যুক্তির কচকচানি করতে দেখলে অবাক হই না। পঁচাত্তরের পর অতি-বাম, অতি-ডান আর স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার, আওয়ামীবিদেষী এবং বঙ্গবন্ধুবিরোধী সুবিধাভোগী সব শক্তিকে এক কাতারে জিগির করতে দেখেছি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবাই জানতেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট তাঁর উন্নয়ন ও নির্বাচনী পরিকল্পনা সব মিলিয়ে গণজাগরণ ঘটিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করতে যাচ্ছেন। সেখানে বিএনপির দুর্গগুলো তছনছ হয়ে যাওয়ায় ও কিছু কিছু জনপ্রিয় প্রার্থীর পরাজয় এবং ভোটপ্রাপ্তির নমুনা দেখে মানুষের মনে সংশয় ও প্রশ্ন জাগলেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ইতিহাস তার মতো করে প্রতিশোধ নিয়েছে। আর যে জিয়াউর রহমান ’৮১ সালের ইডেন কাউন্সিল রাতে বঙ্গভবনে নির্ঘুম কাটিয়েছিলেন। আশা করেছিলেন, নেতৃত্বের লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের ভাঙন নিশ্চিত। কিন্তু ভোরবেলায় যখন শুনলেন, কাউন্সিলর ও নেতা-কর্মীদের তুমুল করতালিতে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দিল্লিতে নির্বাসিত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। তখন তাঁর সামরিক সচিব জেনারেল সাদেক আহমেদ চৌধুরীকে আক্ষেপ করে ‘দেশটা বুঝি ইন্ডিয়া হয়ে গেল’ বলে হতাশ চেহারায় বাড়ির দিকে ছুটেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর তার বিচারের পথ রুদ্ধ হয়েছিল। তাঁর নাম ও ইতিহাস নিষিদ্ধ হয়েছিল। জনগণের ভোটাধিকার নিষিদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে কূটনীতিকের চাকরি দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির জন্য রাজনীতির ময়দান অবারিত করা হয়েছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও তার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতির ময়দান সংকুচিত করা হয়েছিল। সেইদিনও সেনাশাসক জিয়ার গুণকীর্তন করেছেন এসব বিত্তশীলরা প্রতিবাদের সাহস হয়নি। সেদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তানরা সংগঠিত হয়েছিল কঠিন পরিস্থিতির মুখে। আর শেখ হাসিনা এসে পিদিমের আলোর মতো গণতন্ত্রের বাতি জ্বালিয়ে আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। বিচ্ছিন্ন সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ’৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সেনাশাসক এরশাদের লাথি খেয়ে করজোড়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া বিচারপতি সাত্তারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। অসাংবিধানিক সেনাশাসনের গর্ভে জন্ম নেওয়া বিএনপি ও একাত্তরের পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতনির্ভর রাজনৈতিক শক্তির জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন জীবনের শেষ মুহূর্তে সারা জীবনের অর্জনকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, সেটি নাই-বা তুললাম। কিন্তু তিনি যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন, সেদিন কী বলেছিলেন, তা কি এখন মনে আছে? সেটি জানতে খুব ইচ্ছা করছে।
শেখ হাসিনা সোনার চামচ নিয়ে যেমন রাজনীতিতে আসেননি, তেমনি কারও করুণায় বা কোনো অদৃশ্য শক্তির বলে কিংবা বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেননি। দীর্ঘ ২১ বছর ক্লান্তিহীন নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। দলকে শক্তিশালী করেছেন। জনমত সংগঠিত করেছেন। প্রতিটি আন্দোলনে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে ’৯৬ সালে দলকে দুই দশক পর ক্ষমতায় এনেছেন। একুশের গ্রেনেড হামলা ছাড়াও ২৪টি বার তাঁকে হত্যার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। একটি বুলেট যেমন নিয়ত তাঁকে তাড়া করেছে, তেমনি তিনি প্রতিনিয়ত জনগণের মাঝখান থেকে সংগ্রাম করে নিজেকে তৈরি করেছেন।
এ উপমহাদেশেই নয়, আজকের পৃথিবীতে তাঁর মতো একটি বৃহৎ দলের এত দীর্ঘ সময় সফল নেতৃত্বের দাবিদার আর কেউ নন। পঁচাত্তরের পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করেছিলেন। আজকের একুশ শতকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সুদে-আসলে বিএনপির রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করেই দেননি, একটি অভিশপ্ত দলে পরিণত করে দিয়েছেন। নেতৃত্বহীন হতাশ বিএনপির কর্মীরা মাঠে দল ত্যাগ করছে। নেতৃত্বের লড়াই ভিতরে। ভূধর বিএনপিতে সামনে ভাঙনেরও সম্ভাবনা। এই ডিফিকাল্ট অবস্থা থেকে বিএনপি কীভাবে বের হয়ে আসবে সেটি এখন তাদের বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিহাসের এই রায় নিতে শেখ হাসিনাকে দীর্ঘদিন জীবনকে বাজি রেখে রাজনীতিতে কঠিন সংগ্রামের পথ উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। মাহাথির যে পথে আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক হয়ে উঠেছিলেন, সেই পথে আজ শেখ হাসিনা পিতার জন্ম দেওয়া রাষ্ট্র আধুনিক বাংলাদেশের জননী হতে চলেছেন।
বিগত শাসনামলে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ দিয়েছেন। সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেননি। এবার সুশাসন নিশ্চিত করলে, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামের পথে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সেটাতে জয়ী হলে শেখ হাসিনাই হবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের আধুনিক রাষ্ট্রের জননী। কন্যার হাত ধরেই হবে পিতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এই যুদ্ধ কঠিন যুদ্ধ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে, মন্ত্রী-সচিবদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। আইন অনুযায়ী দ্রুত কার্য সম্পাদন এবং কমিশন ও তদবির বাণিজ্যের পথ রুদ্ধ করা। প্রায় ৫০ বছরের অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে লোভ-মোহের আগ্রাসন থেকে নীতিহীনতার পথ থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার এই সংগ্রাম অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্য বিভাগের একজন নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী আবজালের লুটের সম্পদের পরিমাণ চমকে দিয়েছে বাংলাদেশকে। শত শত আবজাল এভাবে জনগণের সম্পদ লুটে নিয়েছে। এই লুটেরা গোষ্ঠীর চেইন বা সিন্ডিকেট ভাঙার নেতৃত্বের শক্তি এ দেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ রাখেন না। আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উচ্চতায় যে মেধা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা, পরিশ্রম ও সাহসের নজির তৈরি হয়েছে, যে জনসমর্থন তাঁর সঙ্গে আছে সে তুলনায় এমন নেতৃত্ব বাংলাদেশে তাঁর ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে কোথাও নেই। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ তিনি চাইলে গড়তে পারেন; এই আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন। তাই বিজয় সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁর নিজের লিখিত মানপত্র পাঠ করতে যখন উচ্চারণ করেন, শেখ হাসিনা জেগে থাকলে বাংলাদেশ শান্তিতে ঘুমায়। এ বাক্যটি মানুষ বিশ্বাস করেছে বলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্যুৎ গতিতে ভাইরাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনা জেগে থাকা মানেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁকে শারীরিক সুস্থতা ও সক্ষমতা দিয়েছেন, সেখানে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর গতিকে অ্যারাবিয়ান ব্ল্যাক হর্সের সঙ্গে তুলনা করা হেেচ্ছ।
পঁচাত্তর-উত্তর যে দীর্ঘ সেনাশাসন ও সেনাশাসনের গর্ভে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক শক্তি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগসহ পক্ষের শক্তিসমহূকে কোণঠাসা করেছিল। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতির বড় সাফল্যই হচ্ছে, সেই শক্তির পুনরুত্থানই ঘটাননি, বাংলাদশেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভয়ারণ্যেই পরিণত করেছেন। আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির জন্য, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য রাজনীতির ময়দান খুব বেশি করে সংকুচিত করে দিয়েছেন। এবং তিনি যে সাফল্য অর্জন করেছেন, সেটি তাঁর রাজনীতিকে নিয়ে জীবনের পরতে পরতে সংগ্রামের এক একটি মাইলফলক অর্জন করে সেটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন। লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।