ঈদের দিনেও বৃদ্ধাশ্রমে স্বজনরা কেউ আসিনি
হাসমত আলী: ঈদে প্রায় সকল বাবা-মা সন্তানের অথবা স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ উদযাপন করেছেন। কিন্ত গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থান করা বেশিরভাগ নিবাসীই ঈদের দিন কাটিয়েছেন সন্তান কিংবা স্বজনদের প্রতীক্ষায়। বরাবরের মতো এবারও ঈদে তারা নতুন কাপড় পেয়েছেন। খেয়েছেন উন্নত খাবার। কিন্ত অধিকাংশই আত্মীয়-স্বজন বা আদরের সন্তানটির দেখা পাননি। অধীর আগ্রহে দিনভর প্রহর গুনেছেন- হয়ত কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। কিন্তু দিন শেষেও কারো সাক্ষাৎ মেলেনি। তবে আশ্রমের ৬২ জন বাসিন্দা ছুটি নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি গেছেন। ঈদের পর দিন মঙ্গলবার সকালে গাজীপুর সদর উপজেলার মনিপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ী এলাকায় অবস্থিত এবং গিভেন্সী গ্রুপের পরিচালনাধীন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের নিবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে এমন কথা জানা গেছে। কথা বলার সময় আপনজনদের কথা স্মরণ করে অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ক্ষোভে-দুঃখে অনেকে স্বজনদের নামও উচ্চারণ করতে চাননি।
চাঁদপুর সদরের ইয়াকুব হোসেন খান (৮৩)। তিনি চাকরি করতেন বিমান বাহিনীর কমিউনিকেশন অফিসার পদে। তার পাঁচ ছেলে এবং দুই মেয়ে। প্রায় ২০ বছর ধরে বড় ছেলে সেলিম আক্তার নিখোঁজ। তাছাড়া স্ত্রীও গত হয়েছেন ১৯/২০ বছরের মতো হলো। বাকি ছেলে-মেযেদের তিনি এমএ পাস কারিয়েছেন। ছেলে-মেয়েরা সবাই বিবাহিত। তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর থাকতেন ঢাকায় ছোট মেয়ের বাসায়। পাঁচ মাস আগে ছোট মেয়ে তাকে এ নিবাসে দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, পেনশনের সমস্ত টাকা তুলে তিনি ছোট ছেলেকে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। কিন্ত ওই ছেলে সেখানে তিন মাসের মতো থেকে দেশে ফিরে আসেন। এখন বছরে একবার মেডিকেল পেনশন (ভাতা) পান। ঈদে সন্তান-স্বজনদের কেউ দেখা করতে এসেছিলেন কি না- জানতে চাইলে কেউ আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এ নিবাসে আছি, এটা ছোট ছেলে জানে না। ইচ্ছা করেই তাকে বলিনি।’
বরিশালের গৌরনদী থানার দিয়াশুর গ্রামের মো. মান্নান হাওলাদার (৭৫)। পাঁচ/ছয় মাস আগে চাচাত ভাই জামাল এবং সৎভাই সালাম তাকে এ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন। তিনি জানান, ব্যক্তি জীবনে তার আপন বলতে কেউ নেই। তিনি বিয়ে করেননি। তার একজন সৎ ভাই এবং চারজন সৎ বোন রয়েছেন। তিনি নিজেদের জমি এবং এলাকায় দিনমুজরি করে জীবন নির্বাহ করতেন। তার বাপ-চাচাদের ৬০ শতক জমি রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা এখানে রেখে যাওয়ার পর আর দেখা করতে আসেননি বা ফোনেও যোগাযোগ করেননি। বলেছিলেন, ঈদের সময় দেখা করতে আসবেন। কিন্ত ঈদের দিন ও পরের দিন সকাল অব্দি তারা আসেননি।
প্রায় ৯ বছর ধরে এ নিবাসে অবস্থান করছেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার কাটরা গ্রামের জরু মিয়া ওরফে সূর্য মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম (৮০)। তিনি জানান, প্রায় ২০ বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। মেয়ে জরিনার বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলে মো. রতন মিয়া কাঠমিন্ত্রীর কাজ করেন। নিজেদের কোনো জমি নেই। গ্রামে থাকা অবস্থায় লোকজনের সহায়তায় দিনাতিপাত করতেন। টেলিভিশনের মাধ্যমে এ বৃদ্ধাশ্রমের খবর পান এবং ছেলে তাকে এখানে দিয়ে গেছেন।
ঈদে কী উপহার পেলেন এবং কী খেয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে সবসময় ভালো খাবার দেওয়া হয়। ঈদে কতৃপক্ষ নতুন শাড়ি, ব্লাউজ ও পেটিকোট দিয়েছে। সকালে সেমাই-মুড়ি, দুপুরে ও রাতে পোলাও, ভাত, মাংস দিয়েছে। তিনি জানান, ঈদে ছেলে-মেয়ে কেউ দেখা করতে আসেনি। তাদের জন্য মনটা কাঁদে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর সদর উপজেলার বিশিয়া-কুড়িবাড়ী মৌজায় ৭২ বিঘা জমি নিয়ে ১৯৯৪ সালে ষাটোর্ধ্ব অবহেলিত, উপার্জনে অক্ষম ও সহায়-সম্বলহীন প্রবীণদের আমৃত্যু আশ্রয়, অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে গিভেন্সী গ্রুপের মালিক খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল কেন্দ্রটি নির্মাণ করেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে হোতাপাড়া-মনিপুর সড়কে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এর পূর্বে ১৯৮৭ সালে থেকে ঢাকার উত্তরায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে এই কার্যক্রম চলে।
বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্বাবধায়ক আবু শরীফ জানান, এখানে ২১০ জন বাসিন্দা রয়েছেন। এদের মধ্যে ১০০ জন বৃদ্ধ এবং ১১০ বৃদ্ধা। এবারের ঈদে ৩০ জন বৃদ্ধ এবং ৩২ বৃদ্ধা ১০ দিনের ছুটিতে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে গেছেন।
তিনি জানান, এবার কেন্দ্রের মসজিদে ঈদের একটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঈদে পুরুষদের জন্য পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, ফতুয়া, শার্ট দেওয়া হয়েছে এবং মহিলাদের জন্য নতুন শাড়ি কাপড়, ব্লাউজ, পেডিকোট, থ্রিপিস, ম্যাক্সি দেওয়া হয়েছে। ঈদের দিন সকালে সেমাই-মুড়ি, খিচুরি, দুপুরে ও রাতে পোলাও, সাদা ভাত গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, এ কেন্দ্রের নিবাসীদের দেখাশোনার জন্য ৫৫ জন স্টাফ রয়েছে। ঈদের দিন নিবাসে অবস্থান করা নিবাসীদের মধ্যে ৫-৬ জনের স্বজনরা দেখা করতে এসেছিলেন। আজও স্বজনরা দেখা করতে আসছেন।