উ. কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বৈঠক ১১ বার ব্যর্থ ১২ বারে সফল
একদিন পরই সিঙ্গাপুরে ঐতিহাসিক বৈঠকে বসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের তিক্ত সম্পর্ক দূর করাই এ বৈঠকের অন্যতম উদ্দেশ্য।পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে পিয়ংইয়ংয়ের আগ্রহের বিষয়টি এরই মধ্যে পরিষ্কার। দেশটি এরই মধ্যে পরমাণু পরীক্ষা কেন্দ্র ধ্বংস করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে কি না, এটা স্পষ্ট নয়। আর এটিই পিয়ংইয়ংয়ের প্রধান চাওয়া। প্রখ্যাত মার্কিন কূটনীতিক জর্জ কেন্নান বলেন, কূটনীতিক ক্ষেত্রে অন্যের চাওয়া পূরণ না করে নিজের প্রত্যাশা পূরণ করা অসম্ভব। এক্ষেত্রে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার ঐতিহাসিক রেকর্ড রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ১১ প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়াকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় শান্তি চুক্তিতে পৌঁছতে পারেননি। তাদের মতোই একই পথে পা বাড়াচ্ছিলেন ট্রাম্প প্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা। পূর্বের প্রশাসনের মতো উদ্ধত ও গোঁড়ামিতে মেতেছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। তারা উভয়ই কিমকে ‘লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির পরিণতির’ ভয় দেখিয়েছিলেন। এতে চটে গিয়ে গত মাসের মাঝামাঝিতে ঐতিহাসিক বৈঠক ভেস্তে যেতে বসেছিল। একই গোঁড়ামি পুষে রাখায় উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিলেন ১১ প্রেসিডেন্ট। কিন্তু কোরীয় শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সফল হওয়ার পথে রয়েছেন।
১৯৫৪ সালের জেনেভা সম্মেলনে কোরীয় উপদ্বীপের ভাগ্যনির্ধারণে আলোচনায় বসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফোস্টার ডুলস (যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪তম প্রেসিডেন্ট ডাউইট এইসেনহাওয়ার প্রশাসনে) প্রতিপক্ষ দেশকে আত্মসমর্পণ করতে হবে- এমন গোঁড়ামি অবস্থান নেন। যদিও তিন বছরের কোরিয়া যুদ্ধ শেষে ১৯৫৩ সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে অস্থায়ী একটি চুক্তি হয়েছিল। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ইস্যু সমাধানে একটা বিশ্বাস অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু চীনের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে অস্বীকার করেন ডুলস। এমনকি চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝউ এনলাইয়ের সঙ্গে করমর্দনও করেননি তিনি। ষাটের দশকে জন এফ কেনেডি (৩৫তম প্রেসিডেন্ট) ও ল্যানডন বি জনসন (৩৬তম প্রেসিডেন্ট) প্রশাসনের সময়কালে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক ছিল। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর গোয়েন্দা জাহাজ ইউএসএস পুয়েবলোকে প্রতিরোধ ও জব্দ করে উত্তর কোরিয়া। এছাড়া ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিমানকে গুলি করে নামায় উত্তর কোরিয়ার মিগ-২১ বিমান। এতে ৩১ মার্কিন সৈন্য নিহত হন। সত্তরের দশকে উত্তর কোরিয়া নতুন নীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালে মার্কিন কংগ্রেসকে চিঠি দিয়ে শান্তি চুক্তিতে অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানায় উত্তর কোরিয়া। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন (৩৭তম প্রেসিডেন্ট) বা জেরাল্ড ফোর্ড (৩৮তম প্রেসিডেন্ট) প্রশাসনের কেউই পিয়ংইয়ংয়ের আমন্ত্রণে পাত্তা দেয়নি।
এরই ধারাবাহিকতায় উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন নেতা কিম ইল-সাং (কিমের দাদা) সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের (৩৯তম প্রেসিডেন্ট) সঙ্গে শান্তি চুক্তির ধারণা তুলে ধরেন। সেটাও সফলতার মুখ দেখেনি। যদিও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সেনা কমানোর নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন কার্টার। এ নীতির বিরোধী ছিল পেন্টাগন। ১৯৮১ সালে ৪০তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় এসে সেনা সংখ্যা বাড়িয়ে দেন রোনাল্ড রিগ্যান। তাত্ত্বিকভাবে শান্তি চুক্তির বিরোধী ছিলেন তিনি। রিগ্যানের উত্তরসূরি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (৪১তম প্রেসিডেন্ট) বিদেশ থেকে পরমাণু অস্ত্র প্রত্যাহার করে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সেনা সংখ্যা হ্রাস করেছিলেন। কিন্তু তিনিও শান্তি চুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা ৪২তম প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন জমে থাকা কোরীয় সংঘাত সমাধানে খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন। ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে ১৯৯৪ সালের ২১ অক্টোবর স্বাক্ষরিত এগ্রিড ফ্রেমওয়ার্ক, ২০০০ সালে জয়েন্ট কমিউনিক ও উত্তরের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে ছয় দলীয় আলোচনা (দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও রাশিয়া) ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। পরবর্তী সময়ে জর্জ ডব্লিউ বুশের (৪৩তম প্রেসিডেন্ট) কঠোর পররাষ্ট্রনীতিতে ক্লিনটনের সব প্রচেষ্টা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। বুশ উত্তর কোরিয়াকে ‘শয়তানের অক্ষশক্তি’ অ্যাখ্যা দেন।
এতে খেপে গিয়ে ২০০৩ সালে পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় উত্তর কোরিয়া। ২০০৬ সালে পরমাণু পরীক্ষা আরও জোরাল করার ঘোষণা দেয় দেশটি। ২০০৯ সালে ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় এসে কৌশলগত ‘ধৈর্যের নীতিতে’ চলতে শুরু করেন বারাক ওবামা। ওবামার এ নীতিও কাজে আসেনি। ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রতিনিয়ত পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে উত্তর কোরিয়ার শক্তিমত্তা দেখিয়ে গেছেন তরুণ নেতা কিম জং উন। বিশ্বমঞ্চের কেন্দ্রবিন্দুতে কিম : বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়ার তরুণ নেতা কিম কোরীয় উপদ্বীপে শান্তির সুশীতল বায়ু বইয়ে দিতে যাচ্ছেন। এক শাসকের কব্জায় থাকায় কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটির আগের দুই নেতা ছিলেন কিমের দাদা কিম ইল সাং ও বাবা কিম জং ইল। তারা উভয়ই বিদেশি সফরকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। বাপ-দাদার নীতি ভেঙে কূটনৈতিক পথে অগ্রসর হয়েছেন ৩২ বছর বয়সী কিম উন। বিশ্ব কূটনীতির মঞ্চে ধীরে ধীরে পাকা হচ্ছেন তিনি। ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠককে কেন্দ্র করে কিমের দিকেই এখন নজর পুরো বিশ্বের।