একটি রোমহর্ষক ঘটনা
নারায়ণগঞ্জ : শফিকুল ইসলাম মঞ্জু। ঢাকার মগবাজারে একটি আবাসিক হোটেলে হোসনে আরা মিমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। রূপ লাবণ্যে মিম এগিয়ে থাকলেও মঞ্জুর কম ছিল না। পরে তাদের প্রেমের পরিণয় ঘটে বিয়ের পিঁড়িতে। ভালোই চলছিল সবকিছু। তাদের কোলজুড়ে আসে এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তান। একসময় সুখের সংসারে আঘাত হানে পরকীয়া। আগুন লাগে বিশ্বাসের ঘরে। নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয় ঝগড়া। এ নিয়ে হাতাহাতি, মারামারি চলতে থাকে। বাবা-মায়ের এ চিত্র দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায় কোমলমতি দুই সন্তান। সবশেষ গত ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বিকালে স্বামী-স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম ঠিক করে। কিন্তু সকালে আকস্মিক স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কারণে বেড়ানোর প্রোগ্রাম ভেস্তে যায়। রাতে নিত্যদিনের মতো দুই সন্তান পাশের রুমে ঘুমিয়ে পড়ে। আরেক রুমে মঞ্জুর দুই বন্ধু নেশার আসর বসায়। অন্য রুমে শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া। পূর্বের ঘটনার মতো মনে করে দুই সন্তান বাবা-মায়ের রুমে যায়নি। রাত ১২টার দিকে ঝগড়ার একপর্যায়ে প্যান্টের বেল্ট দিয়ে মঞ্জু প্রচণ্ড মারধর করে মীমকে। আহত মীম বাঁচার জন্য নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে মঞ্জুর হাতে কামড় দেয়। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। মঞ্জু গলা টিপে হত্যা করে মীমকে। এরপর সারা রাত লাশ গুমের পরিকল্পনা করতে থাকে মঞ্জু। পরে লাশ ঘরে তালাবদ্ধ করে খুব সকালে মঞ্জু দুই সন্তানকে চিড়িয়াখানায় বেড়ানোর কথা বলে বন্ধু স্বপনের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। সন্তানরা মায়ের কথা জানতে চাইলে মঞ্জু বলে, ‘তোমাদের মা একটি জরুরি কাজে বাইরে গেছে’। পরে আসবে। ঘোরাঘুরি শেষে স্বপন দুই সন্তানকে ডেমরার কোনাপাড়ায় মঞ্জুর পরিচিত জনৈক মনিরের বাসায় রেখে আসে। পরে মঞ্জু তার দুই বন্ধুকে নিয়ে নানারকম ফন্দি আঁটতে থাকে লাশ গুমের। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয় বস্তায় ভরে অন্যত্র ফেলে দেবে। সে মতে একটি বস্তায় লাশ ভরে বাথরুমে রেখে দেয়। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত নেয় লাশ পুড়ে ফেলবে। পরিকল্পনা মতো লাশটি একটি ড্রামে ভরে মুখ আটকে রাখা হয়। তিনদিন এভাবে রাখার পর লাশের গন্ধ বের হতে থাকে। কিন্তু গন্ধ যাতে বাসার বাইরে না যায় সে জন্য নানারকম সুগন্ধি ব্যবহার করা হয়। একপর্যায়ে চারদিনের মাথায় গ্যাস পাইপের মাধ্যমে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় লাশের শরীরে। বাসার ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখে স্থানীয় লোকজন গেলে মঞ্জু বলে চুলায় মাংস বসিয়ে ছিলাম। খেয়াল না করায় মাংস পুড়ে গন্ধ বের হচ্ছে এবং ধোঁয়ায় ভরে গেছে। কিন্তু সন্দেহ হয় এলাকাবাসীর। তারা জোর করে ঘরের ভেতর ঢুকে বীভৎস দৃশ্য দেখে আঁতকে ওঠেন। পালানোর আগেই তারা আটক করে মঞ্জুকে। রিমান্ডে থাকার পর আদালতে ১৬৪ ধারায় নিজের দায় স্বীকার করে রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেয় ঘাতক মঞ্জু। ৫ই এপ্রিল সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেয় মঞ্জুর বন্ধু মনির হোসেন ও তার স্ত্রী রোজিনা আক্তার। পরে আদালত মঞ্জু ও মীমের ফুটফুটে দুই সন্তানকে নানীর জিম্মায় দিয়ে দেন। রোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৬শে মার্চ রাত থেকে ৩০শে মার্চ বিকাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ সানারপাড় জনৈক আবদুর রহমান সিকদারের ষষ্ঠতলা বাড়ির চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে। নিহত হোসনে আরা আক্তার মীম বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের ছাত্তারহাট এলাকার আবদুস সাত্তারের মেয়ে। আর ঘাতক শফিকুল ইসলাম মঞ্জু নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের বস্তুল এলাকার মৃত সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩০শে মার্চ রাতেই নিহত মীমের মা শাহনুর বেগম বাদী হয়ে মঞ্জুকে প্রধান আসামি করে ৩ জনের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করে। অপর দুই আসামি হলো মঞ্জুর বন্ধু স্বপন ও হুমায়ুন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) নাসির উদ্দিন সরকার ৩১শে মার্চ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে মঞ্জুকে আদালতে পাঠায়। শুনানি শেষে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশের বক্তব্য
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) নাসির উদ্দিন সরকার জানান, ঘটনাটি অত্যন্ত নৃশংস। মোটকথা আঁতকে ওঠার মতো একটি ঘটনা। মঞ্জুকে রিমান্ডে আনার পর নানা কৌশলে হত্যারহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়। মঞ্জুর বারবার বলতে থাকে মীম আত্মহত্যা করেছে। সে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অনেক বেগ পেতে হয়েছে হত্যারহস্য উদঘাটন করতে। বন্ধু মনির হোসেনকে তার মুখোমুখি করার একপর্যায়ে সে হত্যার কথা স্বীকার করে এবং আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি হয়। ৪ঠা এপ্রিল মঞ্জু হত্যার দায় স্বীকার করে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আক্তারুজ্জামান ভুঁইয়ার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এবং ৫ই এপ্রিল মঞ্জুর বন্ধু মনির হোসেন ও তার স্ত্রী রোজিনা সাক্ষী হিসেবে নারায়ণগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালতে জবানবন্দি দেয়। আদালত মঞ্জুর দুই সন্তান সাদিয়া ইসলাম মনি (১০) ও ইয়াসিন আরাফাতকে (৫) মামলার বাদী শাহনুর বেগমের জিম্মায় দিয়ে দেন।
ওসি নাসির উদ্দিন আরো জানান, ঘাতক মঞ্জু মাদকের ডিলার। সে নিজেও নিয়মিত মাদক সেবন করতো। কক্সবাজারের উখিয়া, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা থানায় মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন অপরাধে তার বিরুদ্ধে ৮টি মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। মামলার অপর দুই আসামি মঞ্জুর সহযোগী হুমায়ুন ও স্বপনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। হত্যাকাণ্ডের সময় এই দুজন ঘটনাস্থলের পাশে ছিল এবং লাশ পোড়াতে মঞ্জুকে সহায়তা করে।
মঞ্জুর মুখে ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা
আদালতে দোষ স্বীকার করে ঘাতক শফিকুল ইসলাম মঞ্জু ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। তিনি আদালতকে বলেন, প্রায় ১৪ বছর আগে হোসনে আরা আক্তার মীমকে বিয়ে করেন। তাদের সাদিয়া ইসলাম মনি নামে একটি মেয়ে ও ইয়াসিন আরাফাত নামে একটি ছেলে আছে। সে সৃজন হাউজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জমি কেনাবেচার কাজে নিয়োজিত ছিল। ব্যবসা খারাপ হওয়ায় একপর্যায়ে ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি শুরু করে এবং নিজেও ইয়াবা সেবন করতো। কক্সবাজার থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট এনে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রি করতো। প্রায় ৩ বছর আগে ইয়াবা ট্যাবলেটসহ কক্সবাজারের উখিয়া থানা পুলিশের হাতে আটক হয়। প্রায় ৩ মাস জেল হাজতে আটক থেকে জামিনে বের হয়। এরপর এক বছর আগে ইয়াবা ট্যাবলেটসহ র্যাব আটক করে। ওই মামলায় প্রায় ১০ মাস জেলখানায় আটক থাকে সে। পরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হাতে কোনো টাকা পয়সা ছিল না। মাদক ব্যবসার অবস্থাও খারাপ ছিল। ওই সময় স্ত্রী মীমের কাছে ৭ লাখ টাকা চেয়েছিল সে। কিন্তু মীম আমাকে টাকাও দেয়নি, আবার অন্য মেয়েদের নিয়ে সন্দেহ করতো। এ নিয়ে প্রায় আমাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হতো। আমি প্রায়ই আমার স্ত্রীকে মারধর করতাম। গত ২৬শে মার্চ বিকালে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকালে আমাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হওয়ায় আর ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ওইদিন রাত সাড়ে ১১টা কি ১২টার সময় আমাদের আবার ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়ার একপর্যায়ে প্যান্ট থেকে বেল্ট খুলে আমার স্ত্রীকে মারধর করি। আমার বেডরুমের দরজা বন্ধ করে মারধর করতে থাকি। বিছানায় ধস্তাধস্তিকালে স্ত্রী আমার বাম হাতের কনুইয়ের নিচে কামড় দেয়। একপর্যায়ে আমি আমার স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করি। ওইদিন আমার বাসায় হুমায়ুন ও স্বপন নামে দুই ব্যক্তি ছিল। ওরা আমার সঙ্গে মাদক ব্যবসা করতো। আমার স্ত্রীকে হত্যা করার পর বেডরুমের দরজা খুলে বিষয়টি ওদের বলি। পাশের রুমে আমার ছেলেমেয়ে ঘুমাচ্ছিল। পাশে অন্য একটি রুমে হুমায়ুন ও স্বপন ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন করছিল। আমার ছেলেমেয়ে যেন বুঝতে না পারে ওদের মা মারা গেছে, সে জন্য পরের দিন ২৭শে মার্চ সকাল ৭টার দিকে চিড়িয়াখানায় বেড়ানোর নাম করে স্বপনের মাধ্যমে ওদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেই। ছেলে ও মেয়ে ওদের মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে আমি বলি ‘তোমাদের মা একটি জরুরি কাজে বাইরে গেছে’। স্বপন আমার ছেলেমেয়েকে সারা দিন ঘোরানোর পর সন্ধ্যায় দিকে ডেমরার কোনাপাড়ায় আমার পরিচিত মনিরের বাসায় রেখে আসে। পরে আমি, স্বপন ও হুমায়ুন পরামর্শ করে আমার স্ত্রীর লাশ অন্যত্র ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সেই মতে লাশ কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে বস্তার মধ্যে ভরে বাথরুমে রেখে দেই। অন্যত্র ফেলতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেই লাশটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলবো। হুমায়ুনকে দিয়ে প্লাস্টিকের বড় আকারের একটি ড্রাম আনাই। লাশটি ড্রামের মধ্যে ভরে ছিপি দ্বারা ড্রামের মুখ বন্ধ করে রাখি। এভাবে তিন দিন তিন রাত পার হবার পর লাশের দুর্গন্ধ বের হয়। দুর্গন্ধ যাতে বাইরে না যায় সে জন্য রুমে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করি। একপর্যায়ে ৩০শে মার্চ আমি, স্বপন ও হুমায়ুন তিনজনে মিলে লাশটি পোড়ানোর ব্যবস্থা করি। আমার বাসায় থাকা সিলিন্ডার গ্যাসের পাইপের সঙ্গে জানালার পর্দা টানানো পাইপ সংযোগ করে রান্নাঘর থেকে গ্যাস লাইনের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ করে আগুন ধরিয়ে লাশ পুড়তে থাকি। একপর্যায়ে লাশ পোড়ানো গন্ধ ও ধোঁয়া জানালা দিয়ে বাইরে বের হলে পাশের ফ্ল্যাট, বিল্ডিং ও মসজিদে নামাজ শেষে মুসল্লিরা আগুন ধরেছে দেখে চিৎকার করতে থাকে। তারা বাসার মালিকসহ আমার বাসায় এসে পুরো ঘটনা দেখে আমাকে আটক করে রাখে। লোকজনের ভিড়ের স্বপন ও হুমায়ুন পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে আমাকে আটক করে।