এগুলো চলছে কার নির্দেশে
ওয়েছ খছরু:
জাফলংয়ে পাথর লুটপাটের দৃশ্য দেখেই ক্ষুব্ধ হলেন সিলেটের এডিএম। ওসি দেলোয়ারকে ডেকে পাঠালেন। বোমা মেশিন দেখিয়ে বলেন, ‘এগুলো চলে কেন, কার নির্দেশে চলছে।’ ওসি দেলোয়ার নির্বাক। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট-এডিএম আরো রাগান্বিত হলেন। বললেন, ‘কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। আসার সময় গুণে আসলাম প্রায় ২০টি বোমা ও শ্যালো মেশিন রয়েছে। এগুলো আজকেই জব্দ করুন। আর আজ থেকে যেন মরণগর্তে কোনো শ্রমিক না নামে সেই ব্যবস্থা করুন। কী করলেন সেটিও আমাকে জানাবেন।’ মঙ্গলবার সিলেটের জাফলংয়ের মন্দিরজুমের দৃশ্য এটি। সিলেটের এডিএম আবু সাফায়াত মো. সাহেদুল করিম হঠাৎ পরিদর্শনে যান জাফলং কোয়ারির আশপাশ এলাকায়। দেখেন শ্রমিকরা ৫০ ফুট গভীর গর্তে খুবলে খুবলে পাথর উত্তোলন করছে। দৃশ্য দেখে তিনি নিজেই নামেন কোয়ারিতে। তাকে দেখে দৌড়াতে থাকেন শ্রমিকরা। গর্তের নিচে শ্যালো মেশিন, বোমা মেশিন চালু অবস্থাতেই ছিল। কেউ কেউ চটের বস্তা দিয়ে সেটি ঢেকে রেখেছিলেন। এডিএম গিয়ে সেগুলো সরান। এরপর তিনি গুনে গুনে দেখেন মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বের অর্ধশতাধিক গর্তে ২০টি মেশিন। তিনি যখন কোয়ারিতে অভিযানে নামেন তখন তার সঙ্গে কোনো পুলিশ ছিল না। পোশাক পরে গোয়াইনঘাট থানার এসআই আতিক কোয়ারির অভ্যন্তরে থাকা টং চায়ের দোকানে বসেছিলেন। পুলিশ খুঁজে খুঁজে একপর্যায়ে ওই দোকানে গিয়ে এসআই আতিকের দেখা পান এডিএম। দোকান থেকে ডেকে বের করে এনে বলেন, ‘আপনার ওসি কোথায়। উনাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল আমরা আসছি। কিন্তু তিনি তো পুলিশ পাঠালেন না। নিজেও এলেন না। তিনি বলেন, ‘আপনাদের চোখ নেই। দেখেও না দেখার ভান করছেন। এসব কী হচ্ছে এখানে। সব শ্যালো ও বোমা মেশিন জব্দ করেন। কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। এখানে যা অবস্থা ওপর ধসে শ্রমিক মারা যাবেই।’ জবাবে এসআই আতিক জানান, ‘তিনি এসেছেন। পুলিশ ফোর্স বল্লাঘাটে গেছে। ওসিও আসার পথে রয়েছেন।’ স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সকাল ১০টার দিকে এসআই আতিক গিয়ে পৌঁছেন জাফলংয়ের জুম এলাকায়। সেখানে নেমেই তিনি পাথরখোকো চক্রের সদস্যদের ডাকেন। এরপর তাদের বলেন, ‘এডিএম আসছেন। দ্রুত সরে যান।’ তার কাছ থেকে তথ্য পেয়ে পাথর সিন্ডিকেটের সদস্যরা পালিয়ে গেলেও অসহায় শ্রমিকের কাছে পৌঁছেনি সে খবর। এ কারণে তারা ঝুঁকিপূর্ণ গর্তের ভেতরে কাজে থাকতে থাকতেই এডিএম গিয়ে অভিযান শুরু করেন। জাফলং কোয়ারির এখন আর অস্তিত্ব নেই। মন্দিরজুমের পাশে রয়েছে পতিত কিছু জমি। প্রতিদিনই পাথরখেকো সিন্ডিকেট একটু একটু করে মন্দিরজুম গিলে খাচ্ছে। মন্দিরজুমের কেয়ারটেকার জানালেন, ‘মন্দিরজুম ভেঙে ভেঙে ভূমিখেকোরা জোরপূর্বক পাথর তুলছে। পুলিশ এসে শাসিয়ে যায়। এ কারণে ভয়ে কেউ মুখ খুলেন না।’ তিনি বলেন, ‘সুপারি ও পানের বাগানে তিনি প্রায় ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে নতুন পানের চারা লাগিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিনই সুপারিগাছসহ ফলদ গাছ কেটে কেটে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।’ অভিযোগের কোনো জায়গা নেই বলে জানান তিনি। দুপুরে সিলেটের এডিএম কোয়ারি এলাকায় অভিযান চালানোর সময় প্রথমেই যান পাথরখেকো বরেনের নেতৃত্বে চলা গর্তে। ওই গর্তেই গত বৃহস্পতিবার এক শ্রমিক মারা যায়। অভিযানের একটু আগেও বরেন খাসিয়া ওই গর্তে ছিল। পুলিশ এসে খবর দেয়ার পরপরই শ্রমিক রেখে তারা পালিয়ে যায়। তার সঙ্গে গর্তে অবস্থান করছিল পুলিশের সোর্স আলিম উদ্দিন, লুটপাটকারী চক্রের হোতা সেলিম, ছোটো হবি, সাবু, ছোটো সাবু, সত্তার, কাদির, আহমদ, ফেনু, মহরম আলী, অবিক, রহম আলী, ইছহাক, হামিদ। গর্তের পাশে চায়ের দোকানে বসা ছিল তারা। খবর পেয়ে তারাও পালিয়ে যায়। একটু পর এডিএম পরে অভিযান চালান সুমনের গর্তে। সুমনের গর্তের গভীর প্রায় ৬০ ফুট। ওই গর্তের ভেতরে প্রায় দুইশ শ্রমিক কাজ করছিল। অভিযান চলার সঙ্গে সঙ্গে তারা পালিয়ে যায়। এরপর হেনরির গর্তে গিয়ে অবাক। ৫০ ফুট উঁচু বিশাল আকৃতির গর্ত সেখানে। প্রায় ৭টি বোমা ও শ্যালো মেশিন লাগানো। মেশিনগুলো চলছিল। বন্ধ করার সময় পায়নি ওরা। এডিএম পুলিশকে ডেকে এনে বললেন, ‘এগুলো জব্দ করেন। মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাদের আটক করতে অভিযান শুরু করেন। যদি আপনি ব্যর্থ হন কোম্পানীগঞ্জের প্রশাসনের মতো অবস্থা হবে।’ এদিকে সিলেট ফেরার সময় রেস্টহাউসে ওসিসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এডিএম। বলেন, ‘দ্রুত ব্যবস্থা নিন। জাফলংয়ে কোনো বোমা মেশিন চলবে না। হাত দিয়ে পাথর উত্তোলন করা যাবে না। আদালতের নির্দেশ যারাই অমান্য করবে, তারা প্রশাসনের হলেও ছাড় পাবে না।’