এস এম পির জন্ম নেপথ্য কথা
শাহরীয়ার বিপ্লব-ফেসবুক থেকে)
২০০৬ সালের ১৮/১৯ অক্টোবর। তৎকালীন সিলেট জেলার এস পি জনাব মল্লিক ফখরুল ইসলাম স্যার, ডি আই জি শাহজামাল রাজ স্যার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আছেন। আমরা চিন্তিত। কি নির্দেশনা আসে। ওয়ারলেসে ডাকলেন কোতোয়ালির ওসি মুকুল স্যার ও আমাকে। আমি তখন জেলার সার্জেন্ট এডমিনের দায়িত্বে। বিএনপি জোট সরকারের শেষ সময়। বাতাসে গুঞ্জন। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। মুকুল স্যার ভাবলেন আমার কিছু হয়েছে। আমি সিভিলে ছিলাম। তিনি রাগ করে বললেন যাও পোষাক পরে এসো। আমি বললাম বাসায় গিয়ে আসতে দেরী হবে। যা হবার হবে চলুন যাই। এসপি স্যারের রুমে ঢুকে মনে হল ভয়ের কিছু নাই। কারণ ডি আই জি স্যার নিজেই আমাদের বসতে বললেন। মুকুল স্যার বসলেও আমি দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা দুইজন সিলেটি অফিসার। আই জি স্যার একটা ফাইল পাঠিয়েছেন। ফাইলটা পাশ করাতে হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মহোদয় এই ফাইলটা একবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখন কেউ উনাকে বুঝাতে পারছেন না। তাছাড়া হাতে আর সময় নাই।২/১ দিনের মধ্যে সই না হলে আর হবে না। আগে এই ফাইলে সিলেটের নাম ছিল না। শুধু বরিশাল মেট্রোপলিটন এর প্রস্তাব ছিল। এখন সিলেট সহ পাঠাইছেন। যেভাবেই পারো সই টা করাতে হবে। আইজি স্যারকে তোমাদের কথা বলেছি। তোমাদের রিওয়ার্ড দেয়া হবে। ডি আই জি স্যার কখনো এত কথা বলেন না কিন্তু এবার বললেন।
এসপি স্যার ফাইলটা মুকুল স্যারের হাতে দিয়ে বললেন, আমি আরিফ ভাইকে বলেছিলাম। উনি বলেছেন পারবেন না। আপনারা এলাকার অফিসার যেভাবে পারেন রাজী করান। এতে তো সিলেটেরই লাভ হবে। মুকুল স্যার হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললাম চলেন আল্লাহ ভরসা। আমরা এসে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্থ আরিফুল হক চৌধুরী কে সব খুলে বলি। তিনি বার বার বলছেন হবে না। স্যার এই সপ্তাহে আর যাবেন না। ঢাকা না গেলে কোন ফাইল সই করবেন না। কিন্তু আমরা বললাম আমাদের বিপদ হতে পারে। মুকুল স্যার বললেন আই জি স্যার নিজে ফোন করছেন আমাকে। আরিফ ভাই বললেন দেখি কি করা যায়। সার্কিট হাউজে স্যার আজকে থাকবেন। তোমরা সার্কিট হাউজে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করো। স্যারের পছন্দনীয় সব মাছ ও মেন্যু বলে দিলেন। এনডিসি সাহেব প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার বাজেট দিলেন। প্রতি বেলা নাকি ১০০ জনের রান্না হয়। সার্কিট হাউজের সব টয়লেট্রিজ এই বাজেটের মধ্যে। এসপি স্যার কে জানালাম। তিনি বললেন তোমরাই ব্যবস্থা করো ।আমরা ব্যক্তিগত টাকায় মতিন ভাইকে নিয়ে (সার্কিট হাউজের বাবুর্চি) বাজার করে নিয়ে আসি। এর মধ্যে আরিফ ভাই জানালেন রাতে গানের ব্যবস্থা রাখলে আরো ভালো হবে। মনিপুরী শিল্পী স্যারের পছন্দ।
সেই ব্যবস্থাও করলাম। আরো বাজেট। রাতের খাবার খেয়ে স্যার তো খুব খুশী। জিজ্ঞেস করলেন কে বাজার করছে? আরিফ ভাই দেখালেন আমাকে। পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুনামগঞ্জ বাড়ী জেনে আরো খুশী হলেন। এর মধ্যে মহানগর বি এন পির আরিফ ভাইয়ের বিরোধী একনেতা বলে উঠলেন, স্যার উনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সামাদ সাবে চাকরী দিছেন। খাস আওয়ামীলীগ। উনি ভাবছিলেন এই কথা শুনে স্যার আরিফ ভাইকে বকা দিবেন। কিন্তু স্যার উলটা ঐ নেতাকে ধমক দিয়ে বললেন, এর লাইগ্যাই খই তুমি বইতল। ছাত্রলীগ আর টাত্রলীগ আছে নি? সিলেটি কি না অটা খউ। ঘুষ খায় না কিতা অটা খউ। স্যারের ধমক খাইয়া নেতা একদম চুপ। সাথে অন্যরা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জেলা প্রশাসক স্যার আরো বাড়িয়ে বললেন। আরিফ ভাই মুচকি হাসছেন।
যাক খাবারের পরে গানের জলসা। আমি উপস্থাপনা করছি। এসপি স্যার বারবার ইশারা করছেন ফাইল ধরার জন্যে। আরিফ ভাইয়ের হাতে ফাইল। কিন্তু ধরছেন না। রাত ১২ টার পরে স্যার গানে মশগুল হাত পা নাচাচ্ছেন। আরিফ ভাই কানে কানে কিছুক্ষনকথা বললেন। এসপি সাহেবকে ডাকলেন মন্ত্রী মহোদয়। জিজ্ঞাস করলেন সব ঠিক আছে নি? জি স্যার ঠিক আছে। ফাইল উল্টাইয়া বললেন, তোমরা বেংগলীরা সিলেটের বালা চাও নি। অউ দেখ সিলেটের মনোগ্রাম নাই, অরগানোগ্রাম নাই, অথচ বরিশালের সব আছে। পিএমও তে গেলে সিলেটের ফাইল্টা ফালাই দিবো। তিনি রেগে মেগে গান বাজনা বন্ধ করে উপরে উঠে গেলেন। এসপি স্যার রাতেই আইজি স্যারকে সব জানালেন। পরে এসপি স্যার আমাকে বললেন রাতের মধ্যেই কাউকে দিয়ে মনোগ্রাম বানাও। স্টেনোকে নিয়ে বসে গেলেন নিজেই অরগানোগ্রাম বানাতে। আমি এতরাতে কি করি। কাকে পাই।মারুফ ভাইকে বাসা থেকে এনে জিন্দাবাজারে দোকান খুলে সারারাতে মনোগ্রাম তিনটি ডিজাইন করি। পরের দিন সকালে আমাকে হেডকোয়ার্টারের এ এস পি স্যার সহ বিমানে ঢাকায় পাঠানো হলো ফাইল সংশোধন করে নিয়ে আসতে। আসার সময় বিমান না পেয়ে মাইক্রোবাসে রওয়ানা দিলাম সিলেটে।
ইতিমধ্যে মন্ত্রী মহোদয় মৌলভীবাজার চলে গেছেন। এসপি স্যার বললেন, তোমরা সেখানেই যাও। আমিও আসছি। রাস্তায় ফোন পেলাম আমাকে মন্ত্রীমহোদয়ের প্রটেকশন ডিউটি দেয়া হয়েছে। যাতে আমি অন্য জেলায় সিভিলে থাকতে কোন ঝামেলা না হয়।
সেখানেও মনিপুরী গানের আয়োজন করতে হয়েছিল আমাদের। রাতে আর ফাইল সই হয় নি। আমাদের থাকতে হয়েছে। পরের দিন সই হয়েছে। এসপি স্যার খুশী হয়ে নিজেই ফাইল নিয়ে ঢাকায় চলে গেলেন। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের ডিউটিতে নিয়োজিত হয়ে গেলাম। এই সময়ে উনার কাছাকাছি যাবার সুযোগ পেয়ে অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি। উনাকে ধরে গাড়িতে উঠাতে বা নামাতে হতো। উনি তখন আমায় ডাকতেন।
যাক এই ফাইল হোম মিনিস্ট্রি, সংস্থাপন হয়ে পিএমও অফিসের অনুমোদন হয় ২৪ তারিখে। ২৫ তারিখ ঈদ ছিল। হাতে আর সময় নেই। হেডকোয়ার্টার জানাল বন্ধের মধ্যেই উদ্বোধন করতে হবে। এসপি স্যার, ডিআইজি স্যার আবার সমস্যায় পরলেন। এসএমপির অফিস নাই, ফার্নিচার নাই, লোকজন নাই, সাইনবোর্ড, গাড়ী নাই, শুধু নাই আর নাই। কমিশনার হিসাবে ডি আই জি স্যারকেই নিয়োগ দেয়া হল। জেলা সদরের দুই থানা নিয়েই যেহেতু মেট্রো সেহেতু দুই থানার লোকবলই এস এম পির লোকবল।
আবারও আরিফ ভাইয়ের শরণাপন্ন হলাম। রাতে আরিফ ভাইকে নিয়ে কমিশনার স্যার, এসপি স্যার, মুকুল সার ও আমি পুরু শহর ঘুরলাম। শেষমেশ নাইওরপুলের বর্তমান এই অফিসটিকেই কমিশনার স্যার পছন্দ করলেন। কিন্তু সনস্যা হল এটা পাউবোর রেস্ট হাউস। কয়েকটা পরিবারও থাকে। উনাদের অফিসারেরা মানছেন না। আরিফ ভাই কমিশনার স্যারকে বললেন আপনারা চলে যান আমি দেখছি। রাত ১০ টায় গিয়ে দেখি সব খালি। কেউ নাই। কিছু লেবার পরিস্কারের কাজ করছেন। আরিফ ভাই ফোনে বললেন লেবাররা আমার। টাকা দেয়া লাগবে না। তোমরা শুধু হোটেলের ভাড়াটা দিয়া দিও। দুইটা পরিবারকে হোটেলে পাঠাইয়া দিছি।
রাত ১১ টায় এসপি স্যার বললেন উদ্বোধনের চিঠি ছাপাতে হবে এবং কালকেই গিয়ে ঢাকায় অফিসিয়েল দাওয়াত দিতে হবে। যেভাবে পারো চিঠি ছাপাও। কিন্তু কাল ঈদ। সব প্রেস বন্ধ। প্রেসের লোকজনও ছুটিতে। কমিশনার স্যার তো ওয়ারল্যাসে বলে ফেললেন সুনামগব্জে যাও কর্মচারী নিয়ে আসো। কি করি। গেলাম বন্ধু রেজুয়ান ভাইয়ের কাছে(তৎকালীন যুগান্তরের ব্যুরো চীফ বর্তমান কাউন্সিলর)। বললাম বাঁচাও। সে বলে কোন উপায় নাই। গেলাম বড়ভাই লোকমান ভাইয়ের কাছে। তিনি বল্লেন, যাও প্রেস খোল। আমি আসছি। আমি মেশিন চালাইমু। রাত ১২ টায় প্রেস খুলি। ভোরে ছাপা শেষ হয়। রেজুয়ান ভাই নিজে সারারাত মেশিন চালায়। আমি শুধু কালি মেশানোর কাজ করি। একটাকাও বিল নেয়নি। এমনকি কাগজও নিজে কিনে এনেছে।
পরের দিন চিঠি নিয়ে একজন এসি স্যার ঢাকায় যান। আমাদেরকে লাগানো হয় অফিস সাজাতে। কিন্তু ফার্নিচার? বন্ধু আত্বীয়দের দোকান থেকে কিছু ফার্নিচার চেয়ে নিয়ে এসেছি। কিছু বাকীতে। আফতাব ভাইয়ের দোকান থেকে কার্পেট এনেছি ধার করে। বাবু ভাইকে দিয়ে ফ্ল্যাগ ফেস্টুন। মাটির আনিসকে দিয়ে সাইনবোর্ড। পরের দিন ২৬ অক্টোবর বিকেল তিনটায় এস এম পির আনুষ্টানিক উদ্বোধন করেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব এম সাইফুর রহমান। ( সাবেক) আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসীব করেন।
(এস এম পির জন্মদিনে এই লেখাটা নিয়েছিলেন আমার এক বন্ধু সাংবাদিক। কিন্তু ছাপলেন না কারন এতে নাকি আমাদের কিছু নেতা অখুশি হবেন। কিন্তু আমার মনে হল একজন মৃত মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি আমার প্রতি কেউ রুষ্ট হন তবু আমার ভিতরে রক্তের স্রোত তো থামাতে পারি না।)