‘ওয়ান ইলেভেন সরকারকে সাহায্য না করলে সামরিক শাসন জারি হত’
ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন বলেন, তখন তারা আমাকে ৪৮ ঘন্টা সময় দিল। চিন্তা করে দেখলাম যে, সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ হতে যাচ্ছে। যেটা আমি পছন্দ করিনি। তখন আমি নিজে নিজে চিন্তা করলাম, আমি নিজে গণতন্ত্রের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছি। আর এখন তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য চাচ্ছে, সেটা আমি কেনো করবো না।
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে ব্যারিষ্টার হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আপনি এমপি হয়েছিলেন। আইন পেশার বাহিরে তখন রাজনীতিতে আসা এবং এমপি হওয়া সেটা কিভাবে হয়েছিল? বিবিসি বাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যরিষ্টার মইনুল হোসেন বলেন, আমি রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেটা সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সামনে রেখে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সাহের মৃত্যুর পরে রাজনীতি থেকে আমার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজে ৭০ সালে নির্বাচনের সময় একবারে আমার বাসায় আসেন এবং আমাকে বলনে, ‘তোকে নির্বাচন করতে হবে’।
তিনি বলেন, তখন যেহেতু আমি দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলাম এবং আমার আব্বা যেহেতু সম্পাদক হিসেবে রাজনীতি করতেন না তাই আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম যে, কাকা আমি তো এই অবস্থায় পারছিনা। ফলে ৭৩ সালে তিনি আবার বললেন যে তুমি হও। তখন আমি রাজি হয়ে যাই।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার যে সম্পর্ক সেটাকি আপনার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে হয়েছে নাকি আপনার বাবার জন্য হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আমার বাবার জন্য হয়েছে।
ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে তাকে দেখেছি। সত্যিকথা বলতে বঙ্গবন্ধুকে আমার আব্বা কাছের ছোট ভাইয়ের মত জানতেন। সেই হিসেবে আমরাও তাকে অনেক সম্মান করতাম, ছোটবেলা থেকেই। অতএব আমাকে যে, তিনি রাজনীতিতে এনেছেন, এটা নিশ্চয়ই মানিক ভাইয়ের ছেলে হিসেবে এনেছেন।
আপনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে যখন বাংলাদেশের সংসদে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা গঠন করা হয় অর্থাৎ যখন বাকশাল গঠন করা হয় তখন আপনি পদত্যাগ করলেন। আপনি আপনার নেতার প্রতি আস্থা রাখতে পারলেন না কেন, এর কারণ কি ? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখেন একটা হলো বঙ্গন্ধুর প্রতি আস্থা রাখা আরেকটা হলো রাজনীতি। জীবনে আমার এটা একটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুকে অনেক শ্রদ্ধা করতাম এবং আমার পদত্যাগ করার বিষয়টা আমার কাছে অনেক কঠিন হয়েছে এবং সত্যি কথা বলতে কি আমি একা একা রাস্তায় হেঁটেছি, এই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছি। কারণ বঙ্গবন্ধু বিব্রত হবেন বলে। কিন্তু আমি সারাজীবন গণতন্ত্রের কথা জেনে ও বলে এসেছি। জেনে এসেছি গণতান্ত্রিক শাসন। এই জন্য আমি আর পারছিলাম না। সেটা আমার কোন বীরত্ব ছিলনা।
তিনি বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। তিনি ওই চিঠি পড়ে আমার প্রতি কোনো রাগ হতে পারলেন না। আমার সাথে তার আগে যে সম্পর্ক ছিল পদত্যাগের পরেও সেটি বহাল ছিল। কারণ তিনি আমাকে ছেলের মত দেখতেন। তাছাড়াও আমার মনে হয় তিনি আব্বার দিকে তাকিয়েই আমার প্রতি রাগ করতে পারলেন না। তার মৃত্যুটা এই জন্যই কষ্টদায়ক।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনার একটা বড় পরিচিতি হয়েছে ২০০৭-২০০৮ সালে যখন সেনা সমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, তারা আমাকে বলেছিল যে, আমরা একেবারে থাকার জন্য আসিনি। আমরা একটা নির্বাচন দিয়ে চলে যাবো। তবে আপনারা যদি না আসেন তাহলে বিষয়টা বিপরীতও হতে পারে। তখন আমি ভাবলাম যে, এই সরকারকে যদি আমি সহযোগিতা না করি আর যদি আমাদের দেশে মার্শালাই আসে তাহলে আমার জীবনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে চেষ্টা ছিল সেটা আবার ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেই হিসেবে আমি তাদের সহযোগিতা করার জন্য যাই।
কিন্তু একটা ধারণা আছে অনেকের মনে যে, বাংলাদেশে তখন রাজনীতিতে কেয়ারটেকার সরকার যে বিষয়টি করতে চেয়েছিল যে, রাজনীতিবিদদের ব্যাপক ধরপাকর, দুই নেত্রীকেও গ্রেফতার। সব মিলিয়ে তখনকার রাজনীতি আরও গভীরে সংকটের দিকে চলে যাচ্ছিল এবং অনেকে বলছিলো যে, আপনার যে পদত্যাগ সেটা তখন একটা অংশগ্রহণমুলক নির্বাচনের পথ তৈরি করার জন্য হচ্ছিল। আপনি থাকা অবস্থায় সেটি সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ সেনাবাহিনীকে এমন পরামর্শ দিচ্ছিলেন। যেটার কারণে তারা হয়তো অন্যদিকে বের হতে পারছিলেন না। এই ব্যপারে আপনার বক্তব্য কি? জবাবে তিনি বলেন, এটা অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এটা আমাকে বলতেই হবে।
তিনি বলেন, আমি গণতন্ত্র চাই তার অর্থ এই না যে, শুধু সিভিলিয়ানদের সহযোগিতায়ই গণতন্ত্র হতে পারে। আমরা কিন্তু রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে আসিনি। আমরা আসছি গণতন্ত্রের জন্য। তখন তাদের কথা হলো। ঠিক আছে আপনারা সেই দিক দেখবেন। কিন্তু দেশের যে দুর্নীতি চলছে এটার বিরুদ্ধে আমাদের একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। এবং সত্যি কথা বলতে কি, তখন কিন্তু সংবাদপত্রেও সেটা লেখা হয়েছে।
তিনি বলেন, তবে আমি মনে করি এবং একটা বিষয় আমি আপনাকে বলছি এবং এটা আপনি ভেরিফাই করে দেখবেন। যে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে যে সমস্ত মামলা করা হয়েছে সেই মামলার কাগজপত্র কিন্তু আগে থেকেই তৈরি ছিল ৯৯ শতাংশ। অতএব এই দিকটা ঠিকনা যে আমরা বিরাজনীতিকরণ করেছি।
তিনি বলেন, তখনকার যুবক অফিসারদের একটা কথা ছিল যে, আমরাতো বেশি দিন থাকবো না। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত। সেই হিসেবে আমি মনে করি তাদের এই চিন্তাটা এইসকল কাজ করার জন্য প্রভাবিত করেছে। যেটা আমি অস্বীকার করবনা।
কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে বা কেন আপনাকে শেষ পর্যন্ত সেই সরকার থেকে সরে যেতে হলো? জবাবে তিনি বলেন, আমার ওপরে পদত্যাগ করতে কোন চাপ সৃষ্টি হয়নি বরং আমিই তাদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছি। যে এক বছর হয়ে গেছে। এখন আমাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করা দরকার।
তিনি বলেন, তখন হয়তো বা তাদের মধ্যে এমন একটা ধারণা হতেও পারে যে, ব্যারিষ্টার থাকলে আমরা যেটা চাচ্ছি সেটা হয়ত হবে না। এটাও হতে পারে কিন্তু পদত্যাগের বিষয়ে তাদের ওপরে চাপ কিন্তু আমারই ছিল।
কিন্তু অনেকের ধারণা যে, রাজনীতিবিদদের সাথে কথা বলে একটা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় আপনি একটা বাধা হয়ে ছিলেন? জবাবে তিনি বলেন, হ্যা আমি তো বললাম যে, হয়তো তাদের একটা ধারণা হতে পারে যেহেতু আমি তখনো রাজনীতি কি সে নিয়ে কথা বলতাম, রাজনীতি কি রকমের হওয়া দরকার সেটাও বলতাম। তখন তারা মনে করছেন যে দুর্নীতির মামলা হচ্ছে এর পেছনে ব্যারিষ্টারের হাত আছে। সেটাই ছিল অসুবিধা।
আপনার কি কখনো মনে হয় যে ঐ কাজটা আমার ভুল হয়েছ? জবাবে তিন বলেন, না আমিতো এমন কোন বড় দায়িত্বে ছিলাম না। আমি একটা চিন্তা ভাবনা নিয়ে লিখেছি, বলার চেষ্টা করেছি। আমার বিবেক যেটা বলেছে সেটাই আমি বলার চেষ্টা করেছি। সেটা আমি বঙ্গবন্ধুকেও বলেছি।
তিনি বলেন, জানি না এটাকে ব্যর্থতা বলা যাবে কিনা। বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার বা আমাদের যে সম্পর্ক ছিল। তখন তার সাথে শেষ যে কথা হয় তখন তিনি এই বাকশাল নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি আমাকে তখন বলেছিলেন যে, তোরা আমার সাথে ঝগড়া কর। আমি কত মানিক ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করেছি। বলতে বলতে তার চোখেও পানি আসলো, আমার চোখেও পানি আসলো। এখন আমার মনে হয় যে, আমার উচিত ছিল যে তাকে জড়িয়ে ধরে বলা যে, কাকা আপনি এটা কইরেন না। কিন্তু এটা আমি করি নাই। এটাই হয়তোবা আমার একটা ব্যর্থতা হতে পারে। তখন আমার বলা উচিত ছিল যে, কাকা আপনি ‘এতে যাইয়েন না’।
সূত্র: বিবিসি বাংলা