ছবিতে সমস্যার শেষ নেই। মৌলিক গল্প, দক্ষ অভিনয়শিল্পী, পাইরেসি, হলসংকট, তথ্যপ্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি। এর ভিড়ে গেল কয়েক বছর ধরে যোগ হয়েছে বিদেশি শিল্পীদের দৌড়াত্ম্য। বিশেষ করে ভারতীয় শিল্পীদের আনাগোনা মাত্রাতিরিক্ত। হুট করেই পরিচালক ও প্রযোজকরা জনপ্রিয়তার নাম ভাঙিয়ে কলকাতার শিল্পীদের নিয়ে আসছেন ঢাকাই ছবিতে কাজ করার জন্য। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছেন জিৎ, দেব, পাওলি দাম, শুভশ্রী, প্রিয়াঙ্কা, ওম, অঙ্কুশ, ঋত্বিকা, সোহম, শ্রাবন্তী, ইন্দ্রনীলসহ আরও অনেকে। এসেছেন আকাশ সেন, স্যাভি, প্রীতমসহ অনেক গায়ক-গায়িকাও। সবাই ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে এদেশের টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। এই মিছিলে আছে অনেক টেকনিশিয়ান, নৃত্য, সঙ্গীত, ফাইট ডিরেক্টর। ওয়ার্ক পারমিট ভিসা ছাড়াই ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশি তারকারা এসে কাজ করে যাচ্ছেন। এতে ট্যাক্সবঞ্চিত হয়ে একদিকে ঠকছে রাষ্ট্র, অন্যদিকে বিদেশি শিল্পীদের সহজলভ্যতায় কমছে দেশি তারকাদের মূল্যায়ন ও কাজ।তাই গেল বছর ধরেই বিষয়টি ছিল আলোচনার শীর্ষে। আর চলতি বছরের শুরুর দিকে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট নানা পেশাজীবীর প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে এ বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস হয় চলচ্চিত্র পেশাজীবীদের নেতৃত্ব দেয়া বিভিন্ন সংগঠন।

সম্প্রতি ঢাকার মাহি ও কলকাতার বনিকে নিয়ে ওয়াজেদ আলী সুমন শুরু করেছেন ‌‘মনে রেখো’ নামে একটি ছবির কাজ। এ ছবিতে বাংলাদেশি দু-একজন অভিনয়শিল্পী ছাড়া সবই নেয়া হয়েছে কলকাতা থেকে। তাই ছবিটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট নানা পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘চলচ্চিত্র ঐক্য জোট’র ক্ষোভ ছিল। তারা বারবার পরিচালক সুমনকে চিঠি দিয়েছেন ও মৌখিকভাবে বলেছেন, দেশি টেকনিশিয়ানদের নিয়ে কাজ করতে এবং বিদেশিদের ক্ষেত্রে ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহার করতে। কিন্তু কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেননি সুমন।

অবশেষে গতকাল বুধবার (২৯ মার্চ) গাজীপুরে গ্রিনটেক রিসোর্টে ‘মনে রেখো’ ছবির শুটিং চলাকালে চলচ্চিত্র ঐক্য জোটের নেতারা উপস্থিত হন। সেখানে পরিচালককে না পেয়ে দায়িত্বে থাকা লোকদের বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট না দেখানো পর্যন্ত শুটিং বন্ধ রাখতে বলেন। এবং পরিচালককে আজ বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) এফডিসিতে বিকেল ৩টায় একটি সভায় উপস্থিত থাকতে বলেন। কিন্তু সুমন তাতে হাজির হননি এবং চলচ্চিত্র ঐক্য জোটের অনুরোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শুটিং আজও চালিয়ে গেছেন। এতে চলচ্চিত্র ঐক্য জোট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চলচ্চিত্র পরিচালকের সনদপত্র বাতিল করবে ওয়াজেদ আলী সুমনের। পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়ায় ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই বিদেশি অভিনয়শিল্পী ও ফিল্ম ওয়ার্কারদের দিয়ে কাজ করানোর জন্য ‘মনে রেখো’ ছবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

এ বিষয়ে পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘আজকের পর থেকে আর কোনো পরিচালকই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে পারবেন না। বারবার সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে কিন্তু কেউ কান দেননি। সস্তার আশায় ট্যুরিস্ট সাজিয়ে বিদেশিদের এনে দেশের টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশীয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের বেকার করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতেছে তারা। এটা আর বরদাস্ত করা হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াজেদ আলী সুমন যা করেছেন তা রীতিমতো ধৃষ্টতা। পরিচালক সমিতি থেকে বারবার বলা হয়েছে তাকে ওয়ার্ক পারমিট দেখাতে। কিন্তু সে শোনেনি। আমরা খোঁজ নিয়েছি সবখানে এবং দেখেছি অবৈধ উপায়ে সুমন তার ছবির শুটিং করছেন। আমরাও রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

পরিচালক সমিতির যুগ্ম মহাসচিব শাহীন সুমন বলেন, ‘আজ ওয়াজেদ আলী সুমনকে ডাকা হয়েছিল এফডিসিতে। তিনি আসবেন বলে কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সবাইকে বসিয়ে রেখেও তিনি আসেননি। গাজীপুরে ছবির শুটিং করছেন। এটা অন্যায়। তার শাস্তি হিসেবেই পরিচালক সমিতি, প্রযোজক সমিতি, শিল্পী সমিতিসহ পেশাজীবী সংগঠনগুলো এক হয়ে ‘মনে রেখো’ ছবির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সেই সঙ্গে এখন থেকে আর কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের ট্যাক্স রক্ষায় ঢাকাই চলচ্চিত্রের সবাই এক হয়ে কাজ করব। আন্দোলন চলবে এর প্রতিরোধে।’ এ পরিচালক নেতা আরও বলেন, অবৈধভাবে বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের আনাগোনা ঠেকাতে সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকবে ঢাকাই ছবির মানুষ। বৈধতায় যেকোনো দেশের শিল্পীই আসুক সমস্যা নেই। কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না। যেখানেই বিদেশি শিল্পীদের শুটিং হোক সেখানেই পুলিশ পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাই এখন থেকে কোনো প্রযোজক ও পরিচালক বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে কাজ করলে সংশ্লিষ্ট সমিতিতে ওয়ার্ক পারমিট জমা দিয়ে ছাড়পত্র নিতে হবে। এ বিষয়ে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন সমিতি শিগগিরই বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

এ বিষয়ে জানতে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন কুমার ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এফডিসির এক কর্মকর্তা জানান, ‘চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোর এ সিদ্ধান্তকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাবে সরকার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটা আরও আগে হলে ভালো হতো।’ কিন্তু এতদিন ধরে অবৈধভাবে বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের আনাগোনা সম্পর্কে জেনেও এফডিসি কর্তৃপক্ষ কেন এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এই প্রশ্নের জবাবে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ওই কর্মকর্তা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn