আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি সিলেটে এক দলীয় অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন দলের মধ্যে ‘কাউয়া’ (কাক) ঢুকেছে। তার এমন বক্তব্যের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম ‘কাউয়া’ নিয়ে তোলপাড়। কাউয়া বলতে উনি কাকে বুঝাতে চেয়েছেন সঠিক ব্যাখ্যা নেই। তবে উদ্ধৃতি দেখলে মনে হয় যারা নামে বেনামে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন বানাচ্ছেন তাদেরকে বুঝিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘প্রচার লীগ, তরুণ লীগ, কর্মজীবী লীগ, ডিজিটাল লীগ, হাইব্রিড লীগ আছে। কথা হাছা, সংগঠনে কাউয়া ঢুকছে। জায়গায় জায়গায় কাউয়া আছে। পেশাহীন পেশিজীবী দরকার নেই। ঘরের ভেতর ঘর বানানো চলবে না। মশারির ভেতর মশারি টানানো চলবে না।’ওবায়দুল কাদের ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা আওয়ামী লীগের তথাকথিত কিছু অঙ্গ সংগঠন এবং এর নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে ‘কাউয়া’ বলে থাকলে যথার্থই বলেছেন। তাদেরকে, তাদের কার্যক্রমকে কঠোর হস্তে দমন করা উচিত। সাইনবোর্ডধারী এসব দোকান, এক একটা চাঁদাবাজির কারখানা। সবার আগে দেখা উচিত ওলামা লীগ নামের সংগঠনটিকে। এর কার্যক্রম আওয়ামী লীগের নীতি আর্দশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

‘কাউয়া’ শব্দটা আওয়ামী রাজনীতিতে নতুন শুনলেও, হাইব্রিড শুনে আসছি অনেক দিন ধরে। বহিরাগত, হাইব্রিড এসব আওয়ামী লীগে প্রায় আলোচিত। যে অর্থে এসব ব্যবহৃত হয় সে অর্থে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় এখনও অনেক বহিরাগত আছেন। অন্য পার্টি থেকে কেউ আওয়ামী লীগে যোগদান করে বছরের পর বছর একনিষ্ঠতার সঙ্গে দল করে থাকলে তাদেরকে ‘কাউয়া’, হাইব্রিড, বহিরাগত এসব বলে বিদ্রুপ করা উচিত নয় মনে করি। কেউ যদি ইনঅ্যাকটিভ থাকে বরং সাধারণ সম্পাদকের উচিত তাদেরকে অ্যাকটিভ করানো।আওয়ামী লীগতো এমন নয় যে, জন্মসূত্রেই কেবল আওয়ামী লীগার হতে পারবে। যে কেউ যে কোনও সময়ে আওয়ামী লীগ করার বা ছাড়ার অধিকার রাখে। এটি একটি গণতান্ত্রিক দল, ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠন নয়।

বঙ্গবন্ধু ৭০ এর নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে ন্যাপ এর আবদুস সামাদ আজাদ, এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগের সৈয়দ আবদুস সুলতান প্রমুখকে আওয়ামী লীগে টেনে এনেছেন। তারা নমিনেশন নিয়ে পাকিস্তান গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একনিষ্ঠতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ করেছেন। সারা বাংলাদেশে এমন হাজারও নেতা রয়েছেন। কত জনের নাম বলবো! আশ্চর্য হই মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, শাজাহান খানসহ বাম ঘরানা থেকে আসাদের নিয়েও দেখি বিদ্রুপ হয়। তাদেরকে আর কত যুগ অপেক্ষা করতে হবে ‘বিশুদ্ধ’ আওয়ামী লীগ হওয়ার জন্য- কে জানে!

অন্যদিকে দেখি নূরে আলম সিদ্দিকীর মতো লোকেরা বলেন, আওয়ামী লীগ এখন আওয়ামী লীগারদের হাতে নেই। প্রশ্ন হচ্ছে ওনার মতো লোকেরা যদি আওয়ামী লীগের বাইরে অবস্থান নিয়ে এসব কথা বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে না জড়ান- তাহলেতো বহিরাগতদের দিয়ে হলেও দল চালাতে হবে। আওয়ামী লীগতো নেতাশূন্য থাকবে না।

দলের মধ্যে কে হাইব্রিড, কে লোব্রিড আর কে ‘কাউয়া’ এসব ব্র্যান্ডিং এর থেকে দেখা উচিত যারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বা আছেন তারা দলের কী উদ্ধার করে দিচ্ছেন। নীতি আদর্শ কতটা ধারণ করেন। আওয়ামী লীগ নেতারা কাদের হাত থেকে ফুলের তোড়া নিয়ে নতুনদের দলে যোগ দেওয়াচ্ছেন, কোন নীতিমালায় নিচ্ছেন। দল যখন ক্ষমতায় থাকে বা ক্ষমতায় যাওয়ার মতো হয় সেখানে ‘কাউয়া’, ‘কোকিল’ সবাই ভিড় করে- এটা স্বাভাবিক। তাদেরকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে- সেটা নির্ধারণ করবেন সাধারণ সম্পাদক বা দলীয় নেতৃত্ব। তাদের নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া সমস্যার সমাধান নয়।

আগামী সাধারণ নির্বাচনের এখনও অনেক বাকি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আবার খুব নিকটে এই নির্বাচন। আগামী বছরের ডিসেম্বর বা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন। বিপদবাঁশি বাজার আগেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাই সবাইকে সর্তক করেছেন। জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়া শুরু করেছেন। সবাই যেন আত্মকলহ ভুলে পরিচ্ছন্নতার পথে ফিরে আসে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ক্ষত খুঁজে সময় কাটাচ্ছেন না, তিনিও ব্যবস্থাপত্রের কথা ভাবছেন।

সংগঠনকে সঠিক পথে আনতে পারলে আওয়ামী লীগের জন্য পর্বত প্রমাণ বাধাও ডিঙিয়ে যাওয়া কোনও কঠিন কিছু নয়। এদেশে এত কর্মী কোনও সংগঠনেরই নেই। মাঠে ময়দানে কাজ করে দৃঢ় অবস্থান নিলেই হয়। বাংলাদেশে ছোট ছোট দলগুলোর মাঝেও বিভাজন আছে।

নির্বাচন তো কঠিন ব্যাপার তার চেয়েও বেশি কঠিন জিতে আসা। একবার ক্ষমতায় থাকলে পরবর্তী নির্বাচনে জিতে আসা কঠিনতম বিষয়। এটা শুধু অনুন্নত বিশ্বে নয় উন্নত বিশ্বেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চার্চিল। চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শক্তিশালী নেতা ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ছিলেন জেনারেল। ময়দানে যুদ্ধ করা সেনাপতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মিত্রশক্তির বিজয় নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। যুদ্ধের পরে ১৯৪৫ সালে ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিলো সে নির্বাচনে ব্রিটেনের মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার অবদান এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা বিবেচনায় নেয়নি। তারা ভোট দিয়ে জিতিয়ে দিয়েছিলো শ্রমিক দলকে। অ্যাটলি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

২০১৯ সাল নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ দশ বছর এক নাগাড়ে ক্ষমতায় থাকবে এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে তৃতীয়বার জিতে আসা হবে কঠিন বিষয়। সর্বোপরি দল যদি অগোছানো অবস্থায় থাকে আর বিদ্রোহী প্রার্থী থেকে নিস্কৃতি না পায় তবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিততে পারবে না। এ কারণে দলের সভানেত্রী সবাইকে সতর্ক করেছেন এবং নিজেও দীর্ঘ ১৯/২০ মাস আগে নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন। নিজেই কুমিল্লার সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে সদরের এমপি বাহার সাহেবকে ডেকে এনে সর্তক করে দিয়েছেন। কারণ কুমিল্লা আওয়ামী লীগের বাহার আর আফজলের মল্লযুদ্ধের কাহিনি সর্বজন বিদিত।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে কর্মীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খুলতে হয়েছিল কারণ নির্বাচনের পরে বিএনপি-জামাতের অত্যাচারে আওয়ামী লীগ কর্মীরা গ্রাম ছাড়া হয়েছিলো। এবার যদি তারা ক্ষমতাচ্যুত হয় জামাত-বিএনপি তাদের ওপর কী অত্যাচার চালাবে তারা জানে! কেউ বলছেন দেশে তিন মাস কোনও সরকারই থাকবে না। আওয়ামী লীগের পক্ষে সে কথা টুকু বিস্মৃত হওয়া আত্মহননের পথ বেঁচে নেওয়া তো একই কথা। কোনও বড় কাজ আরম্ভ করলে তা শেষ করে যাওয়া বা সফলতা দেখে যাওয়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। শেখ হাসিনার ২০২১ সালের সফলতা যদি দেখে যেতে না পারে তবে তা হবে তার সংগঠনের জন্য বড় ব্যর্থতা। যে সংগঠন একটা দেশ স্বাধীন করতে পারে সে সংগঠনের জন্য সফলতা লাভ করা কোনও কঠিন কিছু নয়- যদি তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ থাকে।

আনিস আলমগীর

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn