কারাগারে যেভাবে দিন কাটছে মিন্নির
বার্তা ডেস্ক:: বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিমান্ড শেষে রয়েছেন কারাগারে। গত ১৯ জুলাই রিফাত হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর থেকে তাকে বরগুনা জেলা কারাগারে রাখা হয়। বরগুনা জেলা কারাগারের নারী ওয়ার্ডে বর্তমানে মিন্নিসহ ১৫ জন বন্দি আছেন। রিফাত হত্যা মামলার আরও ১৩ আসামি এ কারাগারের বিভিন্ন সেলে রয়েছে। আলাদা আলাদা রাখা হলেও দিনের বেলায় তাদের দেখা হয়। কারাগারটি পরিসরে ছোট হওয়ায় আসামিদের দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে কিছুটা বিব্রত মিন্নি। চোখের সামনে যারা স্বামীকে কুপিয়ে খুন করল তারাই এখন চোখের সামনে ঘুর ঘুর করছে। শুধু তাই নয়, এসব আসামির সঙ্গে তাকেই কিনা থাকতে হচ্ছে একই কারাগারে। বিষয়টি ভীষণভাবে কষ্ট দিচ্ছে মিন্নিকে।কারাগারে মিন্নির সঙ্গে দেখা করেছেন তার আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম। তিনি জানান, জেলহাজতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মিন্নি। তার দিন কাটছে অনেক কষ্টে। গ্রেফতারের পর তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়েছে জোর করে।
কারাসূত্রে জানা গেছে, কারাগারে মিন্নির দিন কাটছে বিষণ্ণ। সারাক্ষণ বিষণ্ণ মনে বসে থাকেন। তাকে অনেক হতাশাগ্রস্তও দেখা গেছে। বেশিরভাগ সময় তিনি চুপচাপ থাকছেন। তিনি কারাগারে বই পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তার আইনজীবী সেটি কারা কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছেন। কারা কর্তৃপক্ষ আবেদন করলে জেলকোট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলে আশ্বস্ত করেছে। মিন্নির সঙ্গে কারাগারে দেখা করেছেন তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরও। তিনি বাবা ও আইনজীবীকে গ্রেফতারের পর তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন, তার সারা শরীরে ব্যথা, রাতে ঘুম হয় না। জেলহাজতে তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছেন তার আইনজীবী। মিন্নির আইনজীবী জানান, মিন্নি অসুস্থ থাকলেও এখনও কারাগারে কোনো চিকিৎসক তাকে দেখেননি। নার্সের পরামর্শে তাকে মাথাব্যথার ওষুধ দেয়া হয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বরগুনার জেল সুপার। তিনি বলেছেন, মিন্নির মাথাব্যথা ছাড়া আর কোনো অসুস্থতা নেই। এ কারণে তাকে চিকিৎসক দেখানোর প্রয়োজন হয়নি।
জেল সুপার আনোয়ার হোসেন বুধবার জানান, মিন্নির শারীরিক অবস্থা ভালো আছে। তিনি বলেন, তার মাথাব্যথা হয়েছিল। আমাদের নার্সরা তাকে মাথাব্যথার ওষুধ দিয়েছে। এখন মাথাব্যথাও নেই। তবে তাকে অনেক হতাশ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ সময় তিনি চুপচাপ থাকছেন। জেল সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, কারাগারের খাবার খেতে তার সমস্যা হচ্ছে। তবে তার জন্য পিসি কার্ড করা হয়েছে। সেখানে তার বাবা টাকা দিয়েছেন। এই কার্ড দিয়ে তিনি কারা ক্যান্টিন থেকে যেকোনো খাবার খেতে পারবেন। মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম জানান, মিন্নির গায়ে ব্যথা। তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তার চিকিৎসা দরকার। চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে তারা জেল কর্তৃপক্ষকে বলেছেন। এ বিষয়ে জেল সুপার বলেন, মিন্নির বড় ধরণের কোনো অসুস্থতা নেই। বরগুনা জেলা কারাগারে তিন জন ডিপ্লোমা নার্স রয়েছেন। কারাগারে কোনো বন্দি অসুস্থ হলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. হাবীবুর রহমান ব্যবস্থাপত্র দেন। তবে মিন্নিকে এখনও তিনি দেখেননি উল্লেখ করে জেল সুপার বলেন, তাকে দেখানোর মতো অসুস্থতা নেই। নার্সরা তাকে দেখছে।
মিন্নিকে নার্সরা কী চিকিৎসা দিচ্ছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে জেল সুপার বলেন, মিন্নি আমাদের এখানে আসার পর বলেছেন তার মাথা ব্যথা করছে। এরপর নার্সরা দুটি ট্যাবলেট মিন্নিকে দিয়েছে। পর দিন আমি মিন্নির কাছে অসুস্থতার খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। তখন মিন্নি বলেছেন, মাথাব্যথা নেই। এখন ভালো লাগছে। মিন্নি সুস্থ ও স্বাভাবিক আছে। তিনি আরও বলেন, জেলখানায় চিকিৎসার ব্যাপারে আমরা কখনও গাফিলতি করি না। এদিকে মিন্নি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহার করে নিতে চান বলেও আইনজীবীকে জানিয়েছেন। মিন্নির উদ্ধৃতি দিয়ে আইনজীবী আসলাম বলেন, মিন্নি রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা পুলিশ শিখিয়ে দিয়েছে। সেই জবানবন্দি মিন্নি প্রত্যাহার করতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে জেল সুপার বলেন, মিন্নির আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদনের জন্য আইনজীবী একটি দরখাস্ত নিয়ে এসেছিলেন মিন্নির স্বাক্ষর নিতে। জেল হাজতের আইন অনুযায়ী এভাবে কোনো বন্দি কিছুতে স্বাক্ষর করতে পারেন না। তাই আমি তাকে স্বাক্ষর দিতে দিইনি। বরং মিন্নিকে নিয়ম অনুযায়ী আমার কাছে আবেদন করতে বলেছি। মিন্নি আবেদন করলে আমি নিয়ম অনুযায়ী সেই আবেদন আদালতে পাঠাব। কিন্তু মিন্নি এখনও কোনো আবেদন করেননি বা এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলেননি। জেল সুপার আনোয়ার আরও বলেন, আইনজীবীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন তার মক্কেলের জামিনের জন্য বা কোর্টের সহানুভূতির জন্য। এটি স্বাভাবিক। জেলের মধ্যে কোনো বন্দিকে অসুস্থ রেখে আমার ঘুমানোর সুযোগ নেই। বন্দিদের থাকা-খাওয়া, দেখা-সাক্ষাৎ ও চিকিৎসা- এই মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার।
প্রসঙ্গত বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় ২৬ জুন সকাল ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। বিকাল ৪টায় বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এ হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। রিফাত হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে গিয়ে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর থেকে মামলা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ১৬ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বরগুনার মাইঠা এলাকার বাবার বাসা থেকে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বক্তব্য রেকর্ড করতে বরগুনা পুলিশলাইনসে নিয়ে যায় পুলিশ। এর পর দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৯টায় মিন্নিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পর দিন মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। আদালত মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন আদালতের বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী। পর দিন বৃহস্পতিবার বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে জানান, মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
গত শুক্রবার বিকালে মিন্নি একই আদালতে তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এদিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের দাবি, মিন্নির কাছ থেকে জোর করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তিনি এ হত্যা মামলার এক নম্বর সাক্ষীকে (মিন্নি) আসামি করা ও রিমান্ডে নেয়ার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে দায়ী করে আসছেন। শুক্রবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘সবকিছুই শম্ভু বাবুর খেলা। তার ছেলে সুনাম দেবনাথকে রক্ষা করার জন্য আমার মেয়েকে বলি দেয়া হচ্ছে।’ শম্ভুর ছেলে সুনামের বিরুদ্ধে কিশোরের অভিযোগ, তার জন্যই এতদিন মিন্নির পক্ষে আদালতে দাঁড়াননি আইনজীবীরা। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু সমালোচনার পর বরগুনা ও ঢাকার আইনজীবীদের একটি অংশ মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।