কার অধীনে একাদশ নির্বাচন?
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র দেড় বছর বাকি। তবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সহায়ক সরকারের অধীনে নাকি ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে এ নির্বাচন হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা ২০ দলীয় জোটের দলগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজনীতির মাঠে বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অনড় থেকে নির্বাচন বয়কট করে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইস্যুতে অনড় থাকে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদেরও সাড়ে তিন বছর পার হয়েছে। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা/পদ্ধতি নিয়ে আবারও পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে বুধবার প্রথম কার্যদিবসে সচিবালয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে শেষে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা লিখে রাখুন, শেখ হাসিনার অধীনেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন। নির্বাচনে আসা ছাড়া খালেদা জিয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই। পৃথিবীর সব দেশেই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে এবং সহায়তা করবে সরকার। সেই সরকারের নেতৃত্বে থাকবেন শেখ হাসিনা। অন্য কারো এখানে আসার সুযোগ নেই।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলে বিএনপি। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানিকভাবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করতে অনড় থাকে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করে। ইতিমধ্যে সাড়ে তিন বছর পার করেছে সরকার। নির্বাচনের আর মাত্র দেড় বছর বাকি। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনকে লক্ষ্য করে রাজনীতির মাঠে সরব হয়েছে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি। গত বছরের ১৮ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার গুলশানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখার কথা জানান। এরপর নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার দাবিতে দলের নেতারা কথা বলা শুরু করেন। তবে সহায়ক সরকার কেমন হবে, সেই রূপরেখা এখনো ঘোষণা করেনি বিএনপি। জুলাই অথবা আগস্টের মাসের যেকোনো সময় এই রূপরেখা ঘোষণা করতে পারে দলটি।
বুধবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে যদি সহায়ক সরকার হয়, তাহলে সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে একতরফাভাবে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের জন্য সহায়ক। অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে অংশগ্রহণমূক নির্বাচনের জন্য সেটি সহায়ক হবে না।
তার আগে গতকাল কুমিল্লায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না। নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। আর নির্বাচনকালে শেখ হাসিনার সরকারই সহায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে। এটাই আমাদের সংবিধানের নিয়ম।
ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্য দেশকে গভীর বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়ার ইঙ্গিত দাবি করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচনের স্বপ্ন শাসকগোষ্ঠীকে ভুলে যেতে হবে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে কোনো লাভ হবে না। সংবিধান হিমালয় পর্বত নয় যে তাকে নড়ানো যাবে না। দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করা যায়, সংবিধান সংশোধনও সংবিধানের বিধান।
সংবিধান মোতাবেক, ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। সেক্ষেত্রে আগামী বছরের জানুয়ারির শেষদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। আর রোডম্যাপ চূড়ান্ত করার কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর ফলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন অন্য কোনো নির্দলীয় সরকারের সুযোগ নেই। ভোট হবে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। এই সময়ের মধ্যে সরকার পদত্যাগ করে যে অন্য কারো ওপরে দায়িত্ব দেবে, এমন কোনো বিধানও নেই। এক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী ভোট হবে বর্তমান সরকারের অধীনেই। মোদ্দা কথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় নির্বাচন হবে। এর ব্যত্যয় ঘটাতে চাইলে সংবিধানে সংশোধন আনতে হবে। আর বিএনপি যে সহায়ক সরকারের কথা বলছে, সংবিধানে সরাসরি সেরকম কোনো বিধান নেই। নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে ক্ষমতাহীন। ভোটের যাবতীয় কর্মযজ্ঞ পরিচালনা এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করবে নির্বাচন কমিশন। সরকার কেবল রুটিন ওয়ার্ক করবে। নির্বাচন কমিশনের হুকুম তামিল করবে। মাঠ প্রশাসন চলবে নির্বাচন কমিশনের কথায়। ভোটের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারই বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। আর রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে তাকে (সিইসিকে) পরামর্শ দিতে পারবেন।
বুধবার সচিবালয়ে ঈদযাত্রা পর্যালোচনা সভা শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনের কথা তো আট বছর ধরে শুনছি। আট বছরে আট মিনিটও তাদের রাস্তায় দেখিনি সংঘবদ্ধভাবে। সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন হবে। সংবিধানে যেটা আছে সেটা হচ্ছে- ইলেকশনটা ইলেকশন কমিশনের অধীনেই হবে। কোনো সরকারের অধীনে হবে না। ইলেকশনের সময় যেসব বিষয়, মন্ত্রণালয় এবং সংস্থা ইলেকশন রিলেটেড, সেগুলো কিন্তু ইলেকশন কমিশনের অধীনেই ন্যস্ত হবে। তখনকার রুটিন দায়িত্ব পালন করবে যে সরকার, সেই সরকারের পলিসি ডিসিশনে কোনো ভূমিকা থাকবে না। সরকারের কাজ হবে একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, ক্রেডিবল, ফ্রি, ফেয়ার ইলেকশন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা, ফেসিলেটেড করা। এটাকে বলে সহায়ক সরকার। ফেসিলেটেড মানে হলো সহায়তা করা। তখন যে সরকার অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো ক্ষমতায় থাকবে, সেই সরকারের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। তখন এ সরকারই সহায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করবে।