কুযুক্তি-আসিফ মহীউদ্দিন
Asif Mohiuddin (ফেসবুক থেকে
যুক্তিবিদ্যায় স্পেশাল প্লিইডিং হচ্ছে একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি। একে বাঙলায় বলা যেতে পারে, স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি। এই কুযুক্তি কখন হয়, সেটি ব্যাখ্যা করছি। যখন কেউ কোন প্রস্তাব বা নিয়ম দেয়, কিন্তু তার প্রদত্ত নিয়মটি সে নিজেই নিজের বেলাতে ভঙ্গ করে, এবং সেই নিয়ম ভঙ্গ করাকে তিনি শুধুমাত্র তার নির্বাচিত কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ করা যাবে বলে দাবী করে, অন্য কেউ এই প্রস্তাব বা নিয়ম ভঙ্গ করতে পারবে না বলে দাবী করে, তার নিজের ক্ষেত্রে এই সুবিধাটিকে আমরা স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি বা স্পেশাল প্লিইডিং ফ্যালাসি বলতে পারি।
যেমন ধরুন, একটি লজিক্যাল আর্গুমেন্ট দেয়া হলোঃ
১. মানুষ বুদ্ধিমান সত্ত্বা।
২. ইন্টিলিজেন্ট বা বুদ্ধিমান সত্ত্বার একজন স্রষ্টা থাকা আবশ্যিক। স্রষ্টা ছাড়া এত নিখুঁত এবং বুদ্ধি সম্পন্ন কোনকিছু এমনি এমনি হওয়া সম্ভব না।
৩. মানুষের স্রষ্টা আছে।
লক্ষ্য করুন, দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইন্টিলিজেন্ট বা বুদ্ধিমান সত্ত্বার স্রষ্টা থাকা আবশ্যিক। এই প্রস্তাবগুলোকে এবারে ঠিক একই ভাবে ঈশ্বরের ওপর প্রয়োগ করি। সূত্র অনুসারে,
১. ঈশ্বর বুদ্ধিমান সত্ত্বা।
২. ইন্টিলিজেন্ট বা বুদ্ধিমান সত্ত্বার একজন স্রষ্টা থাকা আবশ্যিক। স্রষ্টা ছাড়া এত নিখুঁত এবং বুদ্ধি সম্পন্ন কোনকিছু এমনি এমনি হওয়া সম্ভব না।
৩. ঈশ্বরের স্রষ্টা আছে।
ঠিক একই যুক্তি ঈশ্বরের ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে, দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বরেরও একজন সুপার ঈশ্বর থাকতে হবে। নতুবা, তার মত এত বুদ্ধিমান এবং নিখুঁত সত্ত্বা আসবে কোথা থেকে? এই বিষয়টি উল্লেখ করলেই, স্বাভাবিকভাবেই দেখতে পাবেন, প্রস্তাব যিনি করেছেন, তিনি একটি স্পেশাল প্লিইডিং করবেন। তিনি বলবেন,
– হ্যাঁ তিনি এমনি এমনিই হয়েছেন। তার কোন স্রষ্টার প্রয়োজন নেই। তিনি স্বয়ম্ভু, স্বয়ংসম্পূর্ণ। কারণ, তিনি একটি স্পেশাল ক্যারেকটার। উনি সৃষ্টির উর্ধ্বে। উনার স্রষ্টার প্রয়োজন নেই।
– কিন্তু এত বুদ্ধিমান সত্ত্বা এমনি এমনি অস্তিত্বশীল হয়ে গেল? কোন কারণ ছাড়া? কোন স্রষ্টা ছাড়া?
অর্থাৎ, তারই দেয়া প্রস্তাব বা নিয়ম যখন তার প্রস্তাবের বিপক্ষে যাচ্ছে, তিনি তার ঈশ্বরকে তার নিয়মের উর্ধ্বে কিছু সুবিধা দিচ্ছেন। একেই স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি বলা হয়। আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
প্রস্তাবঃ
১. ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, মুহাম্মদ একজন ঈশ্বর প্রেরিত সম্মানিত বার্তাবাহক।
২. ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে, নবী মুহাম্মদের কোন ছবি আঁকা যাবে না।
৩. নবী মুহাম্মদের ছবি আঁকা সকলের জন্য অন্যায়। সকল ধর্মের মানুষের মুহাম্মদকে সম্মান করতে হবে।
এই প্রস্তাব যিনি দিচ্ছেন, তাকে এবারে এই প্রস্তাবগুলো দেয়া যাকঃ
১. হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, গরু হচ্ছে তাদের দেবতা এবং মাতা।
২. হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, গো হত্যা মহাপাপ এবং ভয়ংকর অন্যায়।
৩. গরু হত্যা বা গরু খাওয়া সকলের জন্য নিষিদ্ধ। গরুকে সকল ধর্মের মানুষের সম্মান করতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি গরু খাওয়া বিরোধী নই। যুক্তির খাতিরে ঐ মুসলিম প্রস্তাবকারীকে এই প্রস্তাবগুলো দেয়া হলে, উনি যা বলবেন তা বলে দিচ্ছিঃ
– “গরু খাওয়া তো ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। অন্য ধর্মের নিয়ম বা আইন একজন মুসলিম কেন পালন করবে? হিন্দু ধর্মের বিধান অনুসরণ করার দায় একজন মুসলিমের নেই। একজন মুসলিম যদি নিজের টাকায় গরু কেনে এবং খায়, কোরবানীর ছবি প্রচার করে, মাংসের রেসিপি প্রচার করে, সেটি তার অধিকার। একজন হিন্দু যদি না খেতে চায়, খাবে না। কিন্তু মুসলিমকে গরু খেতে তো সে বাঁধা দিতে পারে না।”
প্রায়শই দেখা যায়, ইসলামে বিশ্বাসী মানুষ কোরবানীর সময় গরুর কাটা মাথা, জবাই করার ছবি, রক্তারক্তি এগুলো ফেইসবুকে পোস্ট করেন। এতে কিন্তু হিন্দুদের অনুভূতিতেও আঘাত লাগতে পারে। তাদের গোমাতানুভূতি আহত হতে পারে। তারপরেও, উনার এই যুক্তি মেনে নিলাম। এবারে, ঠিক একই যুক্তি নবী মুহাম্মদের ছবি আঁকার বিষয়ে কাজে লাগাই। যদি আমি বলি,
– “মুহাম্মদের ছবি আঁকা তো অন্য কোন ধর্মে নিষিদ্ধ নয়। ইসলাম ধর্মের নিয়ম বা আইন একজন অমুসলিম কেন পালন করবে? একজন অমুসলিম যদি নিজের টাকায় রঙ পেন্সিল, কাগজ, ছবি আঁকার সরঞ্জাম ইত্যাদি কেনে এবং মুহাম্মদের ছবি আঁকে, সেই ছবি প্রচার করে, সেটি তার অধিকার। ইসলামের বিধান শুধু মুসলিমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অমুসলিমের জন্য মুহাম্মদের ছবি আঁকা তো অপরাধ নয়। তাহলে এই বিধান কেন একজন অমুসলিম মানতে যাবে? একজন মুসলিম যদি তা না দেখতে চায়, দেখবে না। কিন্তু একজন অমুসলিমকে মুহাম্মদের ছবি আঁকতে তো সে বাঁধা দিতে পারে না। মুহাম্মদ একজন ঐতিহাসিক চরিত্র। ইতিহাসের যেকোন পাঠক বা ছাত্র তার সম্পর্কে জানবে, তার সম্পর্কে কথা বলবে, আলোচনা সমালোচনা করবে। মুহাম্মদ তো কোন ধর্মের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। ঠিক যেমনটি সত্য বুদ্ধ, যীশু, হিটলার বা স্ট্যালিনের ক্ষেত্রে৷ স্ট্যালিন বা হিটলারের কিছু অনুসারী যদি দাবী করে, স্ট্যালিন বা হিটলার যেহেতু তাদের কাছে সম্মানিত, তাই তাদের সমালোচনা অন্য কেউ করতে পারবে না, তাহলে অন্যদের কী দায়বদ্ধতা আছে এই দাবী মনে নেয়ার? তাই অমুসলিম কেউ মুহাম্মদের ছবি আঁকবে কিনা, তাকে সম্মান দিবে কিনা, সেটি যার যার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয়। মুসলিমরা না চাইলে আঁকবে না। কিন্তু অন্যরা আঁকবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত তারা কীভাবে দেয়?“
এই কথাগুলো বললেই, আপনি সেই মুসলিমের মুখে একটি স্পেশাল প্লিইডিং ফ্যালাসি শুনতে পাবেন। সেটি হচ্ছে, মুসলিমদের গরু খাওয়ার অধিকার আছে। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতি তাতে আহত হলেও তারা মুসলিমের গরু খাওয়ার অধিকার হরণ করতে পারে না। তবে মুসলিম অমুসলিম সকলের নবী মুহাম্মদকে শ্রদ্ধা করতে হবে। কারণ ইসলামের নিয়ম হচ্ছে, কেউই মুহাম্মদের ছবি আঁকতে পারবে না। এই বিধান মানতে সকলেই বাধ্য! কারণ তাতে মুসলিমদের অনুভূতি আহত হয়! তবে অন্যের অনুভূতি আহত হলো কিনা, সেটা দেখার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই মুসলিমের নেই!