কৃষকের মর্মবেদনা যেন যাতনা না হয়
ইফতেখার হোসেন সিদ্দিকী — সুদূর অতীত থেকে বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি উপাখ্যান ঘিরেই গ্রামবাংলার সংস্কৃতি চলমান। কৃষিভিত্তিক সমাজ গঠনের পেছনে নিহিত আছে যৌথ পারিবারিক কাঠামো। কৃষক ভালো থাকলে দেশ ভালো থাকবে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা যারা শহুরে বনে গেছি, তাদের ক’জনই বা কৃষকের খবর রাখি? কৃষকও আজ তাদের ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত করছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু শিক্ষার্থী আছে যারা কৃষক পরিবারের সন্তান। তাদের অনেকে ছুটির সময়ে নিজ বাড়িতে ফিরে পরিবারকে কৃষিকাজে সহায়তা করে থাকেন। ভালো শস্য আবাদে পরোক্ষভাবে তাদেরও আছে ভূমিকা। আমরা জানি, আমাদের দেশ একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা ইত্যাদি নৈমিত্তিক ঘটনা। আবহাওয়ার এ বিরূপ আচরণ মোকাবেলা করে আমাদের কৃষকদের চলতে হয়। তারা রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ক্ষেতে শস্য উৎপাদন করে। তাই কৃষকের অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এটা ঠিক, কৃষকের শিক্ষার জোর কম; কিন্তু তারা সৎ, সহজ-সরল ও কর্মঠ।
বর্তমানে দুনিয়ার সর্বত্র চলছে পুঁজিবাদতন্ত্রের জয়-জয়কার। ঠিক এরকম একটি সময়ে আমাদের দেশের কৃষি পেশাটি হয়ে গেছে অবহেলিত। তাই কৃষকের বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য (ধান) নিয়ে তারা আছে বিপাকে। যে অর্থ খরচ করে তারা ধান উৎপাদন করছে, ধান বিক্রি করে সেই অর্থই তারা পাচ্ছে না। আগে মাঠভরা সোনালি ফসল দেখলে যেখানে কৃষকের চোখ আনন্দে ছল ছল করে উঠত, সেখানে এখন একজন কৃষক এক মণ ধান বিক্রি করে চারশ’ থেকে চারশ’ পঞ্চাশ টাকা পায়। তাহলে কৃষকের চলে কী করে? প্রকৃত অর্থে কৃষকের কষ্টার্জিত ধান বিক্রি করে সে তার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। এর মূলেও রয়েছে নানাবিধ কারণ। রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। কৃষকের উৎপাদিত ধান ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত রয়েছে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। অভিযোগ আছে, চালকল মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা উৎপাদন খরচের অর্ধেক মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে ধান কাটার আগ্রহ যেন তারা হারিয়ে ফেলেছে। যা আবহমান বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না। ফেসবুক কিংবা মিডিয়ার কল্যাণে দেখছি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ধানক্ষেতে নেমে কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন, কৃষককে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু এটি প্রকৃত সমাধান নয়। কৃষকের উৎপাদিত ধান ন্যায্যমূল্যে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনতে হবে। এতে সরকারকে থাকতে হবে অগ্রণী ভূমিকায়। জেলা পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। সারা দেশে ধান রাখার জন্য খাদ্য গুদামের সংখ্যা কম- এমন অজুহাত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে খাদ্য গুদামের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে যেহেতু ধানের উৎপাদন ভালো হয়, তাই বিদেশ থেকে চাল আমদানির প্রবণতা কমিয়ে বরং আমাদের চাল বেশি করে রফতানির ব্যবস্থা বিবেচনায় আনতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব আমাদের সবার। এটা ঠিক, অন্যান্য পেশাজীবীর মতো দেশে কৃষকের কোনো শক্ত সংগঠন নেই। তাই আজ কৃষকের দাবিগুলো যেন মুখথুবড়ে পড়ে না যায় সে কথা দেশের নাগরিক হিসেবে ভাবার প্রয়োজন আছে।–ইফতেখার হোসেন সিদ্দিকী : শিক্ষক, নিবন্ধকার