রাশিম মোল্লা- ১৮ই এপ্রিল সুনামগঞ্জের ৪ উপজেলায় ধান কাটার সময় বজ্রপাতে নিহত হন ৪ কৃষক। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনুযায়ী ৯৭ দশমিক ৫২ শতাংশ সাধারণ মানুষ বা গ্রামগঞ্জের কৃষক শ্রমিক, জেলে শ্রেণি। এর মধ্যে কৃষিকাজে সম্পৃক্তদের নিহতের হার ৭৪ শতাংশ। গত  ১০ বছরে কৃষিকাজ করতে গিয়ে এক সঙ্গে ৪ জনের মৃত্যু উল্লেখযোগ্য। বজ্রপাতে নিহতের এক পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।  সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের তথ্য মতে, চলতি বছরের গত ৩ মাসে শুধু কৃষিকাজ করতে গিয়েই বজ্রপাতে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ পুরো ২০১০ সালে বজ্রপাতে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়। সংগঠনটির গবেষণা মতে, মাঠে কাজ করার সময় কাছাকাছি কোনো নিরাপদ স্থাপনা না থাকায় বজ্রপাতের সময় কৃষক অরক্ষিত হয়ে যান। হাওর অঞ্চলের কৃষক আরো বেশি অসহায়।

নিরাপদ স্থান পেতে কৃষকের সময় লাগে। তাই নিরাপদ স্থাপনায় আশ্রয় নিতে না পেরে গাছের নিচেই আশ্রয় নেন তারা। অথচ বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে অবস্থান করা অনিরাপদ।   সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের নির্বাহী প্রধান (গবেষণা সেল) আব্দুল আলীম বলেন, চলতি বছরের গত ৩ মাসে কৃষিকাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ পুরো  ২০১০ সালে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ১২৩ জন। এবার চলতি বছর শীতের মৌসুম মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে একজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা শুরু হয়। ইতিমধ্যে গতবছরের বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা এ বছর অতিক্রম করেছে।

তিনি বলেন, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দুই বছরে ৩৯৮ জন বজ্রপাতে নিহত হয়েছে। ২০১৯ সালে নিহত হয়েছে ২৬৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২২০ জন, নারী ৪৫ জন, শিশু ১৩ জন এবং ৫ জন কিশোর নিহত রয়েছে। এছাড়া, ১০৩ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৭৭ জন, নারী ২৬ জন, শিশু ৬ জন এবং কিশোর ৬ জন হতাহত হয়েছে। অপরদিকে, আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কম ছিল। ওই বছর বজ্রপাতে মারা যায় ১৩৩ জন। এর মধ্যে ১২৩ জন পুরুষ এবং ১০ জন নারী নিহত হয়।  

সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে বজ্রপাত হয়ে থাকে। তবে কালবৈশাখী সক্রিয় থাকলে বজ্রপাত বেড়ে যায়। চলতি মাসে প্রতিদিনই বজ্রপাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। জুনের এক সপ্তাহে বজ্রপাতে সারা দেশে ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে- ৭ই জুন ৯ জন, ৬ই জুন ২৫ জন, ৫ই জুন ৭ জন, ৪ঠা জুন ৯ জন, ৩রা জুন ৫ জন এবং ১লা জুন একজনের মৃত্যু হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৯ এই এক দশকে দেশে বজ্রপাতে মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৮১। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ২০১৮ সালে। ওই বছর বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৫৯ জন। এর আগের বছর মারা যায় ৩০১ জন, যা গত এক দশকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ২০৫। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ১৬০, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১২ সালে ২০১, ২০১১ সালে ১৭৯ ও ২০১০ সালে ১২৩ জনের মৃত্যু ঘটে বজ্রপাতে। বিভিন্ন হিসাবে দেখা গেছে, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে হাওরের ৩ জেলা কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আর এসব ঘটনা বেশি ঘটে এপ্রিল ও মে মাসে। এ সময় কৃষক ফসল তোলার কাজে মাঠে থাকেন। এ সময়টা কালবৈশাখীর।

গত এক দশকে ঝড়, বন্যা বা অন্য কোনো দুর্যোগের তুলনায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়। বজ্রপাতের ঘটনা প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন স্থানে তালগাছের চারা লাগানো হয়েছে। কিন্তু এ ব্যবস্থা সময়সাপেক্ষ। দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয় চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ২০ দিনে বজ্রপাতে ৫৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। অথচ গত বছরের এপ্রিল মাসে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২১। সংগঠনটির সদস্য সচিব গওহার নঈম ওয়ারা গণমাধ্যমকে বলেন, কৃষককে তো ধান কাটতেই হবে, মাঠে যেতেই হবে। কিন্তু বজ্রপাতের প্রকোপ কমাতে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে এসব অঞ্চলে মুঠোফোনের টাওয়ারে লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যায়। মুঠোফোন কোম্পানিগুলো তাদের করপোরেট দায়িত্বের অংশ হিসেবে কাজটি করতে পারে। পল্লীবিদ্যুৎ ও সীমান্তরক্ষীদের সব স্থাপনায় কমবেশি এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। মুঠোফোনের টাওয়ারে লাইটেনিং এরস্টোর লাগানোর বিষয়টি সরকারও বিবেচনা করেছিল বলে গণমাধ্যমকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। তিনি বলেন, এরস্টোর লাগানো একটি টাওয়ার মাত্র ৯০ মিটার এলাকা কভার করে। আর একটি যন্ত্রের দাম ৭ লাখ টাকা। এটা ব্যয় সাপেক্ষ। এখন কৃষকদের সচেতন করা এবং এলাকায় বড় গাছ সংরক্ষণ করাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn