রাজধানীর একটি অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লেকহেড গ্রামার স্কুল। অতীতে এর এক শিক্ষকের জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ছিল। গত মঙ্গলবার বিকালে হঠাৎ করেই স্কুলটি বন্ধ করে দেয় সরকার। গতকাল সকালে শিক্ষার্থীরা স্কুলটির ধানমন্ডি ও গুলশান শাখায় গিয়ে ঢুকতে না পেরে ফিরে গেছে। একাধিক শিক্ষার্থীকে কান্নাকাটি করতে দেখা গেছে। সেশনের মাঝপথে স্কুল বন্ধ করে দেয়ায় দিশাহারা প্রতিষ্ঠানটির গুলশান ও ধানমন্ডি শাখার ১ হাজার ১৩০ ছাত্রছাত্রী।আর কিছুদিন পর ১লা ডিসেম্বরেই তাদের পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। এ অবস্থায় তারা কোথায় যাবে তার কিছুই জানে না কেউ। অভিভাবকরাও জানেন না তাদের সন্তানদের নিয়ে মাঝপথে কোথায় যাবেন। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে ওই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর পড়াশোনা। গতকাল সকালে গুলশান-১ এর ১৩৫ নম্বর রোডে লেকহেড গ্রামার স্কুলে গিয়ে দেখা যায় এর প্রধান ফটক বন্ধ। অন্য দিনের মতো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আনাগোনা নেই। নেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা গাড়ির ভিড়ও। কিছুক্ষণ পর পর দু-একজন অভিভাবক শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলের সামনে আসছেন। সন্তানদের বাসায় রেখে খবর নিতে আসছেন কেউ কেউ। প্রতিষ্ঠানে ছিলেন না কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তাও।
স্কুলের সামনে উদ্বিগ্ন অভিভাবক বায়েজিদুল হক জানান, তিনি থাকেন রাজধানীর পুরান ঢাকায়। সেখান থেকেই তার সাড়ে তিন বছরের ছেলে ইরাম ও সাড়ে ৬ বছরের ছেলে ইয়াফিকে এখানে আনা-নেয়া করেন। স্কুলটি ভালো হওয়ায় এবং এখানকার বেশ কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন দেশের স্কলারশিপ পাওয়ায় তার দুই সন্তানকেও এ বছর ভর্তি করান বলে জানান। তার আত্মীয়ের আরো ৪ ছেলে-মেয়ে এক স্কুলে পড়ে। তিনি বলেন, আমি গত মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে একটি মেসেজ পাই। স্কুলের পক্ষ থেকে ইংরেজিতে পাঠানো ওই মেসেজে সরকারের পক্ষ থেকে স্কুলটি বন্ধ করে দেয়ার ওই ঘোষণাকে গুজব বলে উল্লেখ করা হয়। সরকারের কোনো নির্দেশনা না আসায় সেই গুজবে অভিভাবকের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই বলেও জানানো হয়। এরপর স্কুল ছুটি শেষে বিকালে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসে তা বন্ধ করে দেয়ার পর আরো একটি ক্ষুদে বার্তা আসে। তাতে বলা হয় আপাতত স্কুল বন্ধ থাকবে। আমরা সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করবো। কয়েকদিনের মধ্যে পরবর্তী মেসেজ জানাতে পারবো বলেও জানানো হয়। এমন সমস্যায় হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, জুলাই-জুন সেশনের এখন মাঝামাঝি সময়। এ অবস্থায় আমার দুই শিশু সন্তানকে কোথায় নেব তার কিছুই জানি না। কী সিদ্ধান্ত আসতে পারে তাও ধারণা করা যাচ্ছে না। কেউ দোষ করলে তার শাস্তি হোক। কিন্তু সবাই কেন কষ্ট পাবে? ক্ষতির শিকার হবে? কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা বন্ধ হবে কেন?
একই ক্যাম্পাসে সপ্তম, পঞ্চম, তৃতীয় ও প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া আরো চার শিক্ষার্থীর এক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করে বলেন, শিশুরা তো আর জঙ্গি তৎপরতায় জড়ায়নি। আমরাও কোন দিন সে ধরনের কিছু শুনিনি। কোনো শিক্ষক জড়িত থাকলে তার শাস্তি হতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের শাস্তি হচ্ছে কেন। শিশুদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। আজ স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে এসে ক্লাসে যেতে না পেরে কেউ কেউ কান্না জুড়ে দিয়েছে। মাঝপথে অন্য স্কুলেও তো যাওয়া যাবে না। কোনোভাবে একটা সুযোগ করে নিতে পারলেও তো বড় অংকের দ্বিগুণ টাকা গচ্চা যাবে।
রাজধানীতে ২০০০ সালে স্কুলটির যাত্রা শুরু। এখন এর দুটি ক্যাম্পাস। ধানমন্ডি ও গুলশান ক্যাম্পাস। ধানমন্ডিতে ও লেভেল পর্যন্ত পড়ানো হয়। আর গুলশানে ক্লাস এইট পর্যন্ত। ধানমন্ডিতে এখন ৭২২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আর গুলশানে ৪০৮। দু’শাখায় এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ হাজার ১৩০। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি। প্রতিষ্ঠানটির দু’শাখায় এখন শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে ১৮০ জন। এর মধ্যে ধানমন্ডিতে ১০০ জন ও গুলশানে ৮০ জন। গত বছরের ১লা জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার সময় ওই স্কুলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জাহিদ খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ৩ মাসের মতো কাজ করেছিলেন। পরে পদত্যাগ করে চলে যান। এরপর জানা যায় জঙ্গি তৎপরতার কথা। পরে পুলিশের অভিযানে মারা যান জাহিদ।
গতকাল স্কুল গেটে কথা হয় গুলশান শাখার পিয়ন পলাশ বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি তার স্ত্রী তৃষ্ণা বড়ুয়া ও অর্ক বড়ুয়াকে নিয়ে স্কুল ভবনেই থাকেন। তিনি বলেন, গতকাল ম্যাজিস্ট্রেট বলে দেন কেউ যেন আর প্রবেশ ও বের না হয়। আমাকে আজকের দিনটা সময় দেয়া হয়েছে। তারপর সিলগালা করে দেয়া হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু এখন মাসের ৮ তারিখে আমি বাসাও পাচ্ছি না। কী করবো বুঝতে পারছি না।
লেকহেডের হেড অব এডমিন আসিফ ইসতিয়াক মানবজমিনকে বলেন, পূর্ব নির্দেশনা বা নোটিশ ছাড়া হঠাৎ করেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়ায় শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। অনেকে কান্নাকাটি করছে। সেনাবাহিনীর রেফারেন্সে এই স্কুলে যোগদানের তিনমাস পর রিজাইন দিয়ে মেজর জাহিদ চলেও যান। কিন্তু কেউ ভেতরে ভেতরে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকলে স্কুল কর্তৃপক্ষ কী তা বুঝতে পারবে? আর এখানে উচ্চবিত্ত ও সচেতন অভিভাবকের সন্তানরা পড়ে। স্কুলে আপত্তিকর কিছু হলে কী তারা মেনে নিতেন। আগে কিছু দিক নির্দেশনা এসেছিল। তাও স্কুল কর্তৃপক্ষ মেনে চলছে। এখন আর এক সঙ্গে নামাজ পড়া হয় না। স্কুল বন্ধ করা হলেও এখন পর্যন্ত আমাদেরকে কোনো লিখিত নোটিশ বা নির্দেশনাও দেয়া হয়নি। এমনকি গতকাল শিক্ষামন্ত্রণালয়ে গিয়েও কোনো নির্দেশনা ও আদেশের কপি পাওয়া যায়নি।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn