খালেদা-তারেককে মাইনাসে তৎপরতা, নজরদারিতে ২৩ নেতা
বার্তা ডেস্ক :: বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দল থেকে মাইনাস করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন বিএনপিরই কিছু নেতা। দলীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করছেন তারা। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন কয়েকজন। দলের এমন ২৩ নেতার ওপর হাইকমান্ডের কড়া নজরদারি রয়েছে। ইতোমধ্যে এমন অভিযোগে দলের দুই ভাইস-চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয়েছে। সদুত্তর না পেলে বহিষ্কার হতে পারেন ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির এসব সন্দেহজক নেতাদের সারিতে প্রথমেই রয়েছেন স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য, সাত ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা চারজন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সংরক্ষিত আসনের সাবেক এক এমপি, এক শিক্ষক নেতা, বহিষ্কারকৃত ছাত্রদল নেতা, মুক্তিযোদ্ধা দলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ও ঢাকা মহানগর বিএনপির ৭ জন সিনিয়র নেতা। যাদের সঙ্গে সরাসরি তারেক রহমান কথা বলছেন এবং দলীয় নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সূত্র জানায়, পদ- পদবিসহ বেশ কিছু ইস্যুতে এসব নেতার সঙ্গে বছর দুয়েক ধরেই বিএনপির হাইকমান্ডের দূরত্ব বাড়ছিল। এর জেরেই তারা গত কয়েক মাস ধরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল এবং সরকারবিরোধী কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। যারা নানা ইস্যুতে হুট-হাট বিভিন্ন ব্যানার নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন তাদের সঙ্গে যোগ দেন। দলকে না জানিয়ে ওসব প্রোগ্রামে অংশ নেন তারা। প্রায়ই গোপন বৈঠকে মিলিতও হন। গোপন খবরের ভিত্তিতে হাইকমান্ড থেকে একাধিকবার ফোন করে সতর্ক করার পরেও তারা কানে তোলেননি।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, কখন মিছিল, সমাবেশ হবে সেটা দল থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। দলীয় নির্দেশের বাইরে গিয়ে কেউ কেউ যদি একদিনে ১০০ লোক নিয়ে সরকার পতন ঘটাতে চায় তবে এটা ষড়যন্ত্র। তারা মনে করেন, এই ঘটনায় কোনো স্যাবোটাজ হতে পারতো। এ রকম ঘটলে পুরো দায় বিএনপির ওপর আসতো।
সিনিয়র নেতারা বলেন, ১/১১- এর সময়ে যেসব নেতা দলের মূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে সংস্কার প্রস্তাব এনেছিলেন তাদের বড় একটি অংশ এবং সাবেক ছাত্র নেতাদের একটি অংশ এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। বেশ কয়েক মাস ধরেই তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। অনেকেই দলের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে আনছেন। কেউ কেউ বছরখানেকেরও বেশি সময় ধরে দলীয় কর্মসূচিতে ‘ইনএ্যাকটিভ’। নেতাদের দাবি, দুয়েকজন দলের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছেন। ধীরে ধীরে তারা তৃতীয় একটা শক্ত পক্ষ তৈরি করছেন যাতে সরকার পতনের পাশাপাশি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সরিয়ে দিয়ে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায়।
গুঞ্জন রয়েছে, সরকার পতনের দাবিতে গত কয়েক দিন ধরে বিএনপি সন্দেভাজন ওইসব নেতারা জামায়াত ও বাম দলসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী কিছু নেতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এজন্য তারা ১৪ ডিসেম্বরকে বেছে নেন। এ খবর লন্ডনে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছলে সেখান থেকে কঠোর বার্তা আসে। এটি দলীয় কোনো প্রোগ্রাম না, কোনোভাবেই নেতাকর্মীরা ওই প্রোগ্রামে যাতে অংশ না নেন সেজন্য প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে কঠোর বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে হাফিজ উদ্দিন ও শওকত মাহমুদ ওই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। এ কারণে তাদের শোকজ করা হয়। হাফিজ উদ্দিনকে ৫ দিন ও শওকত মাহমুদকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শোকজের জবাব দিতে বলা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ১৩ তারিখ রাতে ‘ভাই’ (তারেক রহমান) এর সঙ্গে আমাদের ভিডিও কনফারেন্সে বৈঠক চলছিল এক পর্যায়ে তিনি ছাত্রদলের সভাপতি খোকন ভাইকে খুব কড়াভাবেই বলেন, আগামীকালের প্রোগ্রামে যেনো কেউ না যায়। এটা আমাদের দলীয় প্রোগ্রাম না।
গত ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টন-গুলিস্তান এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করে বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী। ওই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদ, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি উলফাতও সেখানে ছিলেন।
এছাড়া, বিক্ষোভে ২০ দলীয় জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (কাসেমী) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মুঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী ও তার কিছু অনুসারীও অংশ নেন। জমিয়তের একাধিক নেতা জানান, দলের নেতা মাওলানা মনির হোসাইন কাসেমীর উৎসাহেই মাওলানা আফেন্দী তার অনুসারীদের নিয়ে পুরানা পল্টনে অবস্থান করেন।
বিএনপির একাধিক নেতা নিশ্চিত করেন, ওই বিক্ষোভের কথা জানতে পেরে, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে লোক পাঠিয়ে সবাইকে সরে যেতে বলা হয়েছে। এমনকি লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানও উদ্বিগ্ন হয়েছেন। কারা এসব করছেন, সেটা খতিয়ে দেখতে বলেছেন।
নোটিসের জবাব দিতে ৭২ ঘণ্টা বেধে দেয়া হলেও জবাব দেননি ওয়ান-ইলিভেনের সংস্কারপন্থি নেতা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। বিএনপির এ ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, দলের শোকজের চিঠি পেয়েছি। চিঠির উত্তর প্রস্তুত করছি। চিন্তাভাবনা করছি। আমার বক্তব্য শনিবার বেলা ১১টায় বনানীর নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানাব।
তার ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানান, শোকজের লিখিত জবাব সংবাদ মাধ্যমকে জানানোর পর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেবেন হাফিজউদ্দিন। রাজনীতি থেকে তিনি অবসর নেয়ার ঘোষণা দিতে পারেন। তবে বিএনপির একটি অংশ তাকে সংবাদ সম্মেলন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, এক এগারোর পরে যে সব সংস্কারপন্থিদের খালেদা জিয়া আস্থায় আনতে পারেননি তাদের মধ্যে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন অন্যতম। যার কারনে তাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে কখানো নিযুক্ত করা হয়নি। এমনকি তাকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করার একাধিকবার প্রস্তাব আসলেও এক-এগারোর বিষয়টি নিয়ে নেতৃত্বের মাইন্ডসেট হয়ে আছে। এসব কারণে হাফিজ উদ্দিনও সব সময়ই দলে থেকেছেন-‘ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো’।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, এক-এগারোর পর থেকে জিয়া পরিবারের মধ্যে সংস্কারবিরোধী ভাবনাটি প্রবল হয়। ওই সময়ের বিপর্যয়ের পর থেকে সংস্কার-ধারার সক্রিয় কোনো নেতাকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি কাজে খুব একটা নিযুক্ত করা হয়নি। সেই সংস্কারপন্থীদের মধ্যে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সামনের কাতারে। আর এ চিন্তাটিও দলের শীর্ষ নেতৃত্বে সব সময়ই কাজ করেছে। যদিও পরে গত কয়েক বছরে দলের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেয়া হলেও হাফিজ উদ্দিন এতে আগ্রহ দেখাননি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দলের একটি ক্ষুদ্র অংশ শীর্ষ নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে নানা ধরনের ‘বিতর্কিত’ কার্যক্রমে যুক্ত হয়। এ কারণেই আগেভাগে সতর্ক করতেই শোকজ করা হয়েছে দুই সিনিয়র নেতাকে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দলে ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু ‘দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে’ কেউ নন। একটা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী কখনোই দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙতে পারে না। এটা তো একটা নিয়মের মধ্যে আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ ইস্যুতে বৃহস্পতিবার গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন। এরপর তারা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানান, দলের দায়িত্বশীল নেতাদের পরামর্শে হাফিজ উদ্দিন ও শওকত মাহমুদের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও ইতিবাচক। অর্থাৎ তাদের বিষয়ে তিনি কঠোর হবেন না।
এদিকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে শোকজের জবাব দিয়েছেন শওকত মাহমুদ। বুধবার রাতে তার একান্ত সহকারী আবদুল মমিন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জবাব পৌঁছে দেন। শওকত মাহমুদের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, তিন লাইনে তিনি তার জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জাতীয়তাবাদী দলের আদর্শের বাইরে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কাজে তিনি জ্ঞাতসারে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এরপরও তার অজান্তে কোনো কাজে জড়িত থাকলে তার জন্য তিনি দুঃখিত।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে সে সময়ের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া দলে আলাদা কমিটি গঠনের চেষ্টায় ছিলেন। তারা পরিচিত হয়ে উঠেন সংস্কারপন্থি অংশ হিসেবে। তবে সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে দুই বছরেও সফল হননি তারা। বরং মান্নান ভুঁইয়াসহ তার সহযোগীরা দল থেকে ছিটকে যান। যদিও ওই ঘটনা দলে স্থানীয় বিভেদ রেখা তৈরি করে দিয়েছে। মান্নান ভুঁইয়ার অনুসারীদের বড় অংশই এক পর্যায়ে বিএনপিতে ফিরে এলেও দলে তাদের অবস্থান দুর্বল।- পূর্বপশ্চিমবিডি