খুন আর ধর্ষণ করাই যেনো তার নেশা!
মাছ শিকারির ছদ্মবেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। লক্ষ্য খুনের ‘শিকার’ খোঁজা। এতে কখনো একা, কখনো দু-চারজন সহযোগীকে সাথে নিতেন। এলাকার লোকজন তাদের জাল পার্টি হিসেবে জানত। তার সাথে খুনে অংশ নিয়েছেন এমন অন্তত সাতজনকে পুলিশ ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে। এই তালিকায় রয়েছে তার একমাত্র ছেলে ও মেয়ের স্বামীও। আত্মস্বীকৃত ভয়ংকর এই খুনির নাম বাবু শেখ ওরফে আনোয়ার হোসেন ওরফে আনার ওরফে কালু। নওগাঁর রানীনগর উপজেলার হরিশপুর গ্রামের জাহের আলীর ছেলে বাবু শেখ। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই খুনি কিছুদিন আগে নাটোর জেলা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এরপর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে একে একে সব খুনের কথা স্বীকার করেন তিনি। এসব খুনের দায় স্বীকার করে সম্প্রতি কয়েক দফায় বিচারিক হাকিমের (জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের) কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন বাবু শেখ। এর মধ্যে কয়েকটি খুনের ঘটনায় অন্য লোকদের আসামি করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, একজন সাজাও খাটছেন। এদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, খুন করা যেন বাবু শেখের নেশা। বেশির ভাগ খুনই তিনি করেছেন রাতের বেলায়, ঠান্ডা মাথায়। এভাবে গত ছয় বছরে করেছেন ১০ খুন। তার শিকার হয়েছে ১ শিশু ও ৯ নারী। নিহতদের পাঁচজনকে হত্যার আগে ধর্ষণও করেছেন তিনি। পুলিশ কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, একের পর এক খুন করলেও বাবু শেখ কখনো ধরা পড়েননি। এমনকি সন্দেহের তালিকাতেও ছিলেন না তিনি। সেই কারণে প্রতিটি খুনের ঘটনায় আসামি হয়েছে অন্যরা। তাঁদের একজনের যাবজ্জীবন সাজাও হয়েছে। একজন রিমান্ড শেষে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে সাত মাস ধরে হাজত খাটছেন।
যেভাবে খুনের শুরু
বাবু শেখের হাতে প্রথম বলি হন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের ওসমান গণির স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৪৫)। ২০১৩ সালের ২১ আগষ্ট রাতে বাবু শেখ তিন সঙ্গীকে নিয়ে রোকেয়ার ঘরে ঢোকেন। ওই গৃহবধূকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করে পালিয়ে যান বাবু শেখ। এ ঘটনায় নিহতের ভাই একাব্বর হোসেন বাদী হয়ে নলডাঙ্গা থানায় পরের দিন মামলা করেছিলেন। মামলায় যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে রোকেয়ার স্বামী ওসমান গণিকে আসামি করা হয়। বিচার শেষে ওসমান গণিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। তিনি এখনো কারাভোগ করছেন। সম্প্রতি রোকেয়াকে হত্যার দায় স্বীকার করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন বাবু শেখ । এ ঘটনায় তিনি চুরি করেছিলেন মাত্র ১৫০ টাকা। পুলিশ তাঁর জবানবন্দির খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে এর সত্যতাও পেয়েছে।
ছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যা
২০১৪ সালের ৬ মে রাতে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা মোল্লাপাড়া গ্রামের আব্দুর রশিদের মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মরিয়ম খাতুন ওরফে লাবণী (১৩) ধর্ষণ ও খুনের শিকার হয়। বাবু শেখের দেওয়া জবানবন্দিতে জানা যায়, তিনি ও তাঁর শ্যালক রইস মই দিয়ে ওই কিশোরীর ঘরে ঢোকেন এবং দুজনেই তাকে ধর্ষণ করেন। পরে বালিশ চাপা দিয়ে লাবণীকে হত্যা করে পালান তাঁরা। ঘটনার পরদিন মেয়েটির বাবা আব্দুর রশিদ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় কাউকে আসামি করা না হলেও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার দুই তরুণ দীর্ঘদিন হাজতবাস করেছেন। মামলাটি এখনো চলছে।
পাঁচ বছর পর একই পথে
২০১৪ সালে লাবণীকে ধর্ষণ ও হত্যার পর পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় বাবু শেখ ঢাকায় চলে যান। সেখানে তিনি চা বিক্রি শুরু করেন। তাঁর ছিল চার স্ত্রী। ঢাকায় এক স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন তিনি। চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াননি। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শিষ্যদের আহ্বানে তিনি আবার নাটোরে ফিরে আসেন। ওই দিন রাতে সিংড়ার বিগলগলিয়া গ্রামের গৃহবধূ শেফালী খাতুনকে (৪৮) ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে সজীব চৌধুরী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন বাবু শেখ ও তাঁর সঙ্গীরা। আবার শুরু করেন ভয়ংকর সব খুনের ঘটনা।
এক মাসে তিন খুন
গত ১৫ মে রাতে নলডাঙ্গার বাঁশিলা উত্তর পাড়ার মাহমুদুল হাসানের স্ত্রী হালিমা খাতুনকে (২০) ধর্ষণের পর হত্যা করেন বাবু শেখ। এ সময় তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলে আব্দুল্লাহকে (২) বাড়ির পাশের পুকুরে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা ওমর ফারুক বাদী হয়ে নিহত গৃহবধূর দেবর মাহাবুল আলমকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মাহাবুল আলমকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। পরে তিনি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তবে এসবই মিথ্যা প্রমাণ করেছেন বাবু শেখ। গ্রেপ্তারের পর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় ওই ঘটনার দায় স্বীকার করেন তিনি। পুলিশ যাচাই–বাছাই করে তাঁর স্বীকারোক্তির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। এ ঘটনার এক মাসের মধ্যেই একই গ্রামের পূর্বপাড়ার আমেনা বেওয়াকে (৫৮) শ্বাসরোধ করে হত্যা করে বাবু শেখ ও তাঁর সঙ্গীরা। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে আলম আলী এলাকার ইউপি সদস্য সুরুজ ব্যাপারী ও কাঠমিস্ত্রি সাইফুল ইসলামকে আসামি করে মামলা করেন। তাঁরা দীর্ঘদিন কারাবাস শেষে সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
টাঙ্গাইল জেলায় দুই খুন
বাবু শেখের এক আত্মীয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলে। সেখানে বেড়াতে গিয়েও তিনি চুরি করার জন্য দুই নারীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। গত ৯ জুলাই রাত ১০টার দিকে জেলার সখীপুর উপজেলার হাতীবান্ধা গ্রামের বাবর আলীর স্ত্রী সমলা বেওয়াকে (৬০) একা পেয়ে তাঁর ঘরেই হত্যা করেন বাবু শেখ। এর প্রায় দুই মাস পরে ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে মির্জাপুর উপজেলার হরতকীতলা গ্রামের কানচু খানের স্ত্রী রুপভানু বেগমকে (৬০) হত্যা করেন বাবু শেখ। সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে রুপভানুকে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে ৪৪ হাজার টাকার জিনিসপত্র চুরি করে পালান বাবু শেখ। স্থানীয় পুলিশ এ দুটি ঘটনার রহস্য আজও উদ্ঘাটন করতে পারেনি। তবে নাটোর জেলা পুলিশের হাতে আটক হয়ে বাবু শেখ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই দুই হত্যার দায় স্বীকার করেন।
এক রাতে দুই খুন
৯ অক্টোবর রাত আড়াইটা। নাটোরের লালপুর উপজেলার নারী আনসার সদস্য সাহেরা বেগমের গলার চেইন চুরি করতে তাঁর শোবার ঘরে ঢোকেন বাবু শেখ, তাঁর সহযোগী আসাদুল ও রুবেল। প্রথমে তাঁরা ওই নারীকে ধর্ষণ এবং পরে গলা টিপে হত্যা করেন। সবশেষে ওই নারীর গলার স্বর্ণের চেইন, কানের দুল ও ১টি মোবাইল ফোন চুরি করে নিয়ে নাটোরের দিকে ফিরতে থাকেন তাঁরা। এক কিলোমিটার যাওয়ার পরই তাঁদের দ্বিতীয় খুন করার ইচ্ছে জাগে। জয়ন্তীপুর গ্রামে রাস্তার পাশের এক বাড়িতে জানালা দিয়ে অমেজান বেওয়া (৬০) নামের এক বৃদ্ধাকে ঘুমাতে দেখেন তাঁরা। খোলা দরজা দিয়ে তাঁরা ওই ঘরে ঢুকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঘুমন্ত বৃদ্ধাকে হত্যা করেন। শোকেসের কাচ ভাঙতে গিয়ে জোরে শব্দ হওয়ায় আশপাশের লোকজন ছুটে এলেও অল্পের জন্য খুনিরা ধরা পড়েননি। এই দুটি ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
যেভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন বাবু
আনসার সদস্য সাহেরা বেগমের চুরি করা মোবাইল ফোনটি ব্যবহার শুরু করে বাবু শেখের শ্যালক রুবেলের ছেলে। পুলিশ ওই মোবাইল ফোনে আড়ি পাতে। ফোনটির ব্যবহারকারীর গতিবিধির ওপর নজরদারি শুরু করা হয়। একপর্যায়ে মোবাইল ফোনসহ রুবেল ও তাঁর ছেলেকে পুলিশ আটক করে। তাঁদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বাবু শেখকে নাটোর রেলস্টেশন থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
কেন বারবার নারীদের খুন করেন
বাবু শেখকে কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। সম্প্রতি তাঁকে আদালতে নেওয়ার পথে তাঁর সঙ্গে কথা হয় একজন গণমাধ্যম প্রতিনিধির। বাবু শেখের দাবি, রানীনগরের এক ইউপি চেয়ারম্যান তাঁকে একটি হত্যা মামলায় মিথ্যাভাবে জড়ান। সেই রাগে তিনি গ্রাম ছেড়ে নাটোরে চলে আসেন। প্রথম দিকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাছ মেরে জীবিকা অর্জন করতেন। পরে কাজকর্ম না হওয়ায় তিনি ‘জাল পার্টি’তে যোগ দেন। জাল পার্টির লোকজন মাছ মারার অছিলায় গ্রামে গ্রামে চুরি করে বেড়ায়। চুরি করতে গিয়ে নারী ধর্ষণ ও খুনের নেশায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। কেন বারবার নারীদের খুন করেন—এই প্রশ্নের জবাবে বাবু শেখ বলেন, তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সব সময় দুর্বলদের ওপর হামলা করতেন। যেসব নারী একা ঘরে ঘুমান এবং শারীরিকভাবে দুর্বল, তাঁদের হত্যা করে চুরি করা সহজ। তাই নারীদের খুন করতেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব নারীকে ধর্ষণও করতেন তিনি। বাবু শেখ আরও বলেন, ‘আমি ভুল বুঝতি পারিছি। আমাক ভালো হওয়ার সুযোগ দিলে ভালো হয়ি যাব।’
ধর্ষণের পর খুন করেননি একবার
বাবু শেখ জানিয়েছেন, তিনি জীবনে শুধু একজন নারীকেই ধর্ষণের পর খুন করেননি। তবে ১৫০ টাকা চুরি করেছিলেন ওই নারীর বাড়ি থেকে। এ ঘটনা ঘটেছিল নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায়। খুন না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই নারী ধর্ষণে বাধা দেয়নি। তাই মারিনি।’ ওই ঘটনার শিকার নারী আজও মামলা করেননি।
এখন পুলিশ যা বলছে
বাবু শেখকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদে সবচেয়ে বেশি সময় খাটিয়েছেন পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকরামুল ইসলাম। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, তাঁর কর্মজীবনে তিনি এ ধরনের খুনির দেখা পাননি। বাবু শেখ ঠান্ডা মাথায় খুন করে গেছেন, কিন্তু প্রমাণ রেখে যাননি। তাঁকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে পেশাদার খুনি চক্রকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, বাবু শেখ অপরাধ জগতের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। ছোটখাটো চুরি করতে গিয়ে প্রত্যেক নারীকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছেন তিনি। ছিল না কোনো প্রমাণ। পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘এত দিন বাবু শেখ পুলিশের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকায় অনেক নির্দোষ মানুষ হয়তো বিভিন্ন মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন। আমরা তাঁর প্রতিটি ঘটনা সূক্ষ্মভাবে যাচাই–বাছাই করছি। তাতে এখন পর্যন্ত তিনি তাঁর স্বীকারোক্তিতে মিথ্যা বলেছেন, এমনটা মনে হয়নি। তাঁকে ধরার মধ্য দিয়ে এ সমাজে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে।’