ঘুমন্ত মৌলবাদকে জাগিয়ে দিলেন মৃণাল হক-পীর হাবিব
পীর হাবিবুর রহমান-
সব আমলেই মৃণাল হক, তার শক্তির উৎস কোথায়? কেউ বলতে পারে না। বাবা অধ্যাপক একরামুল হক ভাষা আন্দোলনের মিছিলের মুখ ছিলেন। রাজশাহী কলেজের শিক্ষক ছিলেন। আইয়ুবের ফৌজি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন। রাজশাহী কলেজ থেকে চাকরি চলে গিয়েছিল। জীবন-জীবিকার জন্য রাজশাহীর প্রগতিশীল সহমর্মীরা তার প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়েছিলেন। জীবিকানির্বাহের জন্য একটি সেকেলে লেটার প্রেস বা ছাপাখানা দিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে সামরিক ক্যু-পাল্টা ক্যুর পথ ধরে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসলেন। স্বাধীনতাবিরোধী দক্ষিণপন্থি, অতিবিপ্লবী চীনাপন্থি রাজনীতিবিদসহ সমাজের নানা মত পথের মানুষকে তার দল গঠনে শরিক করলেন। সেই রাজনীতিতে রাজশাহীতে যুক্ত হলেন অধ্যাপক একরামুল হক।
ভাস্কর মৃণাল হকের বাবা একরামুল হক ক্ষমতার দৌড়ে হোঁচট খেলেন। এমরান আলী সরকার হয়ে গেলেন মন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার শাসনামলের শেষ দিকে একরামুল হককে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ দিলেন। এতেই একরামুল হকের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। অঢেল সম্পদের মালিক হতে থাকলেন। দূর হতে থাকল অভাব-অনটন। পুত্র মৃণাল হকেরও দাপট বাড়তে থাকল পিতার ক্ষমতার আলোয়।
এরশাদ জামানার শেষে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করলেও রাকসুতে ছাত্রলীগ ঐক্য থেকে ছিটকে পড়ে। ভিপি-জিএসের কোনো একটি না দেওয়ায় এটি ঘটে। রাকসু নির্বাচনে পাবনা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক প্রভাব প্রবল। সেখানে ছাত্রলীগ আমাকে সিনেট ও পত্রিকার সম্পাদক পদে মনোনয়ন দিয়েছিল। কথা ছিল ঐক্য হলে পত্রিকার সম্পাদক পদ থাকবে। কিন্তু ঐক্য ভেঙে যাওয়ায় আমাকে দুটোই করতে বলা হয়। আমি পত্রিকা সম্পাদক পদে ভোট না চেয়ে সিনেটে একটি করে ভোট চাইতে থাকলাম। সেই সময় শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে শীতের মিষ্টি রোদ পোহানো বাংলা বিভাগের এক অপরূপা, হালকা-পাতলা গড়নের কাঁচা হলুদ রঙের তরুণীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেল। সে তার বন্ধুদের নিয়ে আমার জন্য ভোট চেয়েছে। সেই মেয়েটির নাম স্নিগ্ধা। পরবর্তীতে জেনেছি, সেই সুন্দরী তরুণী যার সঙ্গে আমার মিষ্টি সখ্য গড়ে উঠেছিল, সে মৃণাল হকের ছোট বোন এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের শ্যালিকা। স্নিগ্ধার প্রতি ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়েই আজকের চলমান পরিস্থিতিতে আমাকে লিখতে হবে।
সেই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনে অগ্নিমুখর পাঁচ দফার আন্দোলন গোটা মতিহারজুড়ে। সারা বাংলাদেশ জেনে গেছে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী উপাচার্য আবদুল বারীকে শহীদ জোহার রক্তস্নাত মতিহার ক্যাম্পাস থেকে তাড়াতে চায় ছাত্র সমাজ। সেই আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন প্রয়াত বিচারপতি বজলুর রহমান ছানা ও সাবেক রাকসু জিএস খন্দকার জাহাঙ্গীর কবির রানা। সেই সময়টা ছাত্রলীগের জন্য ছিল অনেক বৈরী। উগ্রপন্থি, বিপ্লবী আর সেনাশাসকদের প্রতিহিংসার মুখোমুখি কঠিন বাস্তবতার মুখে ছাত্রলীগ রাকসু জয় করেছিল। আজকের আওয়ামী লীগ সরকারের বেনিফিশিয়ারি অংশীদাররা যারা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম জপতে জপতে মুখে ফেনা তোলেন, তারা সেদিন রাকসুর অভিষেকে ছাত্রলীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বুকে বঙ্গবন্ধু ছবি শোভিত ব্যাজ লাগাতে দেননি। শেষ পর্যন্ত ভিসি মকবুলার রহমান সরকার ও সাবেক রাকসু ভিপি নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডুর মধ্যস্থতায় ছাত্রলীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর ছবির বদলে কালো মুজিব কোট গায়ে পরে উঠেছিলেন অভিষেক মঞ্চে। সেই দুঃসময়ে একরামুল হক ও তার পুত্র ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক মৃণাল হক বিনা উসকানিতে, বিনা কারণে রাজশাহী নগর থেকে ট্রাকভর্তি গুণ্ডা ভাড়া করে ক্যাম্পাসের হলে হলে ঘুমন্ত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার তাণ্ডব চালিয়েছিলেন।
আজকের বাংলাদেশে আকস্মিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য বিকৃতভাবে অর্থাৎ বাঙালি নারীর শাড়ি পরিয়ে স্থাপন করে স্থিতিশীল পরিস্থিতি ও ঘুমন্ত মৌলবাদকে জাগিয়ে দিলেন মৃণাল হক। এক কথায় বিষয়টি সহজ সমীকরণের নয় যে, এটা মৌলবাদীদের সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত নিঃশ্বাস। জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে শোলাকিয়ার পর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নামাজের শেষে মুসল্লিরা যখন ডান দিকে সালাম ফেরাবেন তখনই এই নারীর ভাস্কর্য চোখে পড়বে। এটা ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হেফাজতে ইসলাম প্রতিবাদ করলে কওমি মাদ্রাসার নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি বলেছেন যে এটি তারও পছন্দ নয়। এটা এখানে বসাবে কেন, আর বিকৃতভাবেই উপস্থাপন করা হবে কেন?
ভাস্কর মৃণাল হক এ মূর্তি সরানোর পর কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছেন, তার মায়ের মৃত্যুতেও তিনি এমন করে কাঁদেননি। এর চাইতে আত্মপ্রতারণা, এর চাইতে নিজের অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার আর কী আছে! কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন পর্যন্ত বলেছেন, যার মা আছে সে গরিব নয়। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে একজন পেশাদার ভাস্করের ভাস্কর্য সরানোর বেদনার তুলনা হতে পারে না। এ ভাস্কর্য সরানোর জন্য শাহবাগ থেকে হাই কোর্ট এলাকা পর্যন্ত অনেকে প্রতিবাদ করেছেন। যেদিন হেফাজত মহাপ্রলয় নিয়ে ঢাকা নগরীতে ভয়ঙ্কর রকমের ত্রাস ও তাণ্ডব শুরু করেছিল, তখন এ প্রতিবাদীরা প্রতিরোধে নামেনি। পল্টন থেকে মতিঝিল সেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দু-চারজন রাজনীতিবিদ মন্ত্রীকে নিয়ে এক রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই মহাপ্রলয় মোকাবিলা করেছিলেন। সেই দিন শুধু বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াই হেফাজতের পাশে ঢাকাবাসীকে নেমে আসার আহ্বান জানাননি, অনেক রাজনৈতিক শক্তিও শসার বস্তা, পানির জার নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিন তাদের রুখতে গণজাগরণ ঘটানোর মতো নেতৃত্ব বা সংগঠকদের ঢাকার বুকে নামতে দেখা যায়নি। হাতেগোনা যে কয়জন নেমেছিলেন, প্রেস ক্লাব পর্যন্ত গিয়েই ফটোসেশনের মাধ্যমে ইতি টেনেছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা থাকেন, তাদেরকে কৌশলের আশ্রয় যেমন নিতে হয় তেমনি সব মত-পথের দাবি-দাওয়াকে আমলে নিয়েই স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার চিন্তা করতে হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসন কবলিত বাংলাদেশে সংবিধানের মূল নীতিকে কাটাছেঁড়াই করা হয়নি, রীতিমতো তুলে দেওয়া হয়েছে। খুনি মোশতাক ইসলামী প্রজাতন্ত্র বানিয়ে তার টুপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। সামরিক শাসকরা ধর্মের রাজনীতিকে উসকে দিয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান থেকে মুছে গেছে। সমাজতন্ত্র সামাজিক ন্যায়বিচার হয়ে গেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা শুধু দেওয়া হয়নি, রাজনীতিতেও নামানো হয়েছে। সংসদে বসানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতে তাদের রাজনৈতিক সংগঠনকে সশস্ত্র উল্লাস করতে দেখা গেছে। এমনকি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম থেকে জাতীয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধ হয়েছিল।
সামরিক শাসনের পর ’৯১ সালের অবাধ নির্বাচনে আওয়ামী লীগবিরোধী সব শক্তির ঐক্যের কারণে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। সেদিন বিরোধী দলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলের আনা বিলের প্রেক্ষিতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল সর্বসম্মতিক্রমে। কিন্তু গত ২৬ বছরে গণতান্ত্রিক শাসকরা রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে দিনে দিনে দুর্বল করেছেন। সংসদকে দিনে দিনে দুর্বল থেকে অকার্যকর করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে ছাত্ররাজনীতিকে আদর্শভিত্তিক তারুণ্যের শক্তি থেকে বিচ্যুত করেছেন। প্রশাসনকে দলীয়করণের সর্বোচ্চ আগ্রাসনে পতিত করেছেন। নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসকে খর্বই করেননি, প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা দুর্বলই হয়নি, শক্তিশালী সরকারের বিপরীতে শক্তিশালী বিরোধী দলের উত্থান ঘটেনি।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের ইতিহাসকে সবাই মিলে বিকৃতই করেননি; সবার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করেছেন। সব পেশাজীবীকে দলের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। রাজনীতিতে নজিরবিহীন প্রতিহিংসার আগ্রাসনে গ্রেনেড, বোমায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বাংলাদেশ। একুশের গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, তার বীভৎস চিত্র রাজনীতিতে দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। আস্থা ও বিশ্বাস রাজনীতিতে নির্বাসিত হয়েছে। ২৬ বছরে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না দেওয়া, জাতীয় ইস্যুতে বড় দলগুলোর ঐকমত্যে না আসায় ইতিহাসের পেছনে ফিরে তাকালে এ সত্যই উদ্ভাসিত হয়, সেদিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয়ের সম্ভাবনা থেকে কারাবন্দী সেনাশাসক এইচ এম এরশাদকে ঠেকাতেই মূলত সবাই সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার আলোর পথে হেঁটেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে যখন যারা সরকারবিরোধী তাদের জন্য গণতান্ত্রিক শাসন দিনে দিনে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে।
’৯১ সালের পরাজয়ের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শক্তি ঐক্যের মোহনায় মিলিত হয়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তিতে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিভক্তি আনা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনে জামায়াতকে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক করা হয়েছিল। সেই কৌশল বাস্তব ছিল বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের মধ্য দিয়ে ’৯৬ সালের নির্বাচনে ২১ বছর পর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছিলেন। বিএনপির শাসকরা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন দলীয়করণের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। রাজনৈতিক সহিংসতার মুখে বিএনপি যখন রক্তক্ষয়ী বাংলাদেশে একদলীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছিল তখন সহিংস সংঘাতের অন্ধকার রাজনীতির বুক চিড়ে জনসমর্থন নিয়ে ওয়ান-ইলেভেন এসেছিল জাতির জীবনে।
সেই সময়ের রাজনৈতিক সমঝোতা শেষ করে দেওয়া, শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলায় উড়িয়ে দেওয়া সবকিছুই ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফসল। কিন্তু সেই ওয়ান-ইলেভেন আসার মধ্য দিয়ে রাজনীতিবিদ থেকে সিভিল সোসাইটির অনেক দেশপ্রেমিক মানুষকে প্রশ্নবিদ্ধই করেনি, দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর নামিয়েছিল অত্যাচার আর দুঃশাসন। সেই দুঃশাসনের যাত্রাপথে এখন পর্যন্ত নির্যাতনের কাঠগড়ায় সর্বোচ্চ যন্ত্রণা ভোগ করছে বিএনপি। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার একক চ্যালেঞ্জ ও ক্যারিশমায় ওয়ান-ইলেভেনকে পরাস্ত করে ২০০৮ সালে অবাধ নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত হয়ে ব্রুট মেজরিটি নিয়ে মহাজোটকে ক্ষমতায় এনেছিলেন।
বাংলাদেশে এখন নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে তারাই সর্বোচ্চ শাস্তি ভোগ করেছে। যারা ওয়ান-ইলেভেনে জীবনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে মাটি কামড়ে পড়ে ছিল, দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিল তারা বেনিফিশিয়ারি হতে পারেনি। যাদেরকে বিএনপি-জামায়াত শাসকরা এবং ওয়ান-ইলেভেনের শক্তি অবাধ বিচরণের সুযোগ দিয়েছিল তারাই ক্ষমতার স্বাদ সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেছে। তাদের ছায়ায় সুবিধাভোগীরা বিগত নয় বছরের শাসনামলে প্রশাসনের ছায়ায় উন্নয়নের মহাযজ্ঞের আড়ালে খেয়েদেয়ে নাদুসনুদুস হয়েছে। রাজনীতি হয়েছে বাণিজ্যিকীকরণের শিকার। একসময় আওয়ামী লীগ সামরিক শাসকদের নির্যাতনের স্ট্রিমরোলার সয়ে প্রতিবাদের মাটি কামড়ে যে শক্তি অর্জন করেছিল, সেটি আজকের আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা ভুলে গেছে। সুবিধাভোগীদের কখনো জীবনের ঝুঁকি নিতে হয় না। পুলিশি নির্যাতন, রিমান্ড ও কারাদহন সইতে হয় না। শেখ হাসিনার উন্নয়নের মহাসড়কে পশ্চিমাদের কাছেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার বাঘ। কিন্তু সুশাসন নিশ্চিত না করায় অর্থনৈতিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম লুটপাট হওয়ায় নয় বছরের শাসনামলে নতুন ভোটারসহ আওয়ামী লীগই সমালোচনার মুখে। দেশের ভোটের রাজনীতিতে ভোটব্যাংক বলতে আওয়ামী লীগেরই রয়েছে। বাদবাকি যেটুকু তা এরশাদের জাতীয় পার্টির। আওয়ামী লীগ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য দলকে তৃণমূল পর্যায়ে বিভক্ত করেছে। অন্যদিকে বিএনপি তার শাসনামলের পাপের প্রায়শ্চিত্ত নয় বছরে অনেক করেছে। সরকারের নির্যাতনের মুখে সেও হয়েছে পোড়খাওয়া দল। শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে বিএনপির কাছ থেকে জামায়াতকে সরিয়ে ’৯৬ সালে দলকে ক্ষমতায় আনা তেমনি তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে ওয়ান-ইলেভেনের চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসিতে ঝুলানো। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ে আসেনি বলে আওয়ামী লীগ সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার রায় কী হবে, সেই অনিশ্চয়তা সামনে নিয়েও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ২০১৪ সালে বলেছিলেন, নির্দলীয় সরকার নেই, তিনি নির্বাচনেও নেই। এবার বিএনপি বলছে, নির্বাচনী সহায়ক সরকার কপালে জুটুক আর নাই জুটুক নির্বাচনে আছে। বিএনপির প্রার্থী বাছাই, প্রার্থীদের সবুজ সংকেত দান, জেলা কমিটি ঘোষণা চলছে। যারা ভাবছেন বিএনপি শেষ তারা অঙ্কের ফলাফল মিলাতে ভুল করছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই বিএনপি যখন ভোট লড়াইয়ে নামবে তখন দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে যেতে পারে। নির্বাচন কমিশন থেকে মাঠ প্রশাসন সেই অযোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারে যারা মানুষের জন্য কিছু করতে পারে না, প্রভুকেও কিছু দিতে পারে না।
’৯৬ সালের নির্বাচনে দাপুটে আমলারা ও ৭৩ ব্যাচের তোফায়েল ক্যাডাররা নৌকার পক্ষে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগ ছিল ঐক্যবদ্ধ। জনমতও ছিল অনুকূলে। তারপর হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উঠে আসতে হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর মাঠ প্রশাসনের নাটাই যাদের হাতে তারা ছিলেন শেখ হাসিনার পাশে। এখন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট। প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের মতো শক্তি দৃশ্যমান নয়। জনগণের মধ্যে সরকারবিরোধী সমালোচনা রয়েছে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলেই এদেশের মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব জাগতে থাকে। বিএনপির অতীতের পাপ ভুলতে বসেছে। নয় বছর ক্ষমতায় নেই। তাদের ওপর সমালোচনার ভারও কম। এমনি পরিস্থিতিতে বিএনপি নেত্রী রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা করলে শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও তার প্রশংসা করেছেন। আগামী ভোটযুদ্ধে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে আওয়ামী লীগ হাসতে হাসতে বিজয় লাভ করবে এমনটি ভাবা সহজ অঙ্কের ফলাফল নয়।
শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়কের জায়গা থেকে হোক আর ভোটের রাজনীতির হিসাব থেকেই হোক উপলব্ধি করেছিলেন যে, এদেশের মাদ্রাসা অনেক। এরা এদেশেরই নাগরিক। দেশেরই সন্তান। তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে মৌলবাদী ভোটের একটি বড় অংশ হেফাজতি বা কওমিদের পক্ষে টেনেছিলেন। যেটি ’৯৬ সালের শাসনামলে কৌশলগত ভুল পদক্ষেপে পিটিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটকে বিএনপির সঙ্গে সুসংহত করেছিল। শেখ হাসিনা যেখানে হেফাজত-কওমিদের নিয়ে খেলেছেন ম্যারাডোনার মতো, সেখানে আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের কোনো ভাস্কর্য তৈরি না করা মৃণাল হকের দেবী থেমিসের সৃষ্টি ফের বিতর্কের ঝড় তুলেছে। মনে হচ্ছে কোথায় যেন খেলা শুরু হয়েছে। মৃণাল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদ জামানায় উপাচার্য প্রফেসর আমান উল্লাহ ও উপ-উপাচার্য প্রফেসর আবদুল হাই শিবলীর উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের, শিক্ষক-কর্মচারীদের সহায়তায় বড় ধরনের কমিটি গঠনের মাধ্যমে সিনেট ভবনের সামনে নীতুন কুণ্ডুকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘শাবাশ বাংলাদেশ’ বসিয়েছিলেন, সেটিরও বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে বিএনপি-জামায়াতের শিক্ষকরা তাকে দিয়ে ‘শাবাশ বাংলাদেশের’ কাউন্টার ’৬৯-এর শহীদ শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার কবরের খানিক দূরেই ‘সুবর্ণ স্মারক’ বসিয়েছিলেন। অদৃশ্য ক্ষমতাবানদের চাপে মৃণাল হক অনেক স্পন্সর জোগাড় করে ঢাকা নগরীতে বেশ কিছু ভাস্কর্য করলেও তার শিল্পমান নিয়ে হাজার প্রশ্ন রয়েছে। এদিকে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের টানাপড়েন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আইন মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগ এখন মুখোমুখি। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে কোথায় যেন, নানামুখী খেলা শুরু হয়েছে। যে খেলার আলামত শুভ মনে হচ্ছে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।