চরম দূর্দিন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে, দেখার কেউ নেই
দোয়ারাবাজার :: একাত্তরের রণাঙ্গনের যুদ্ধাহত প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা গুলজার আলী। শেষ বয়সে এসে বিভিন্ন জটিল রোগে ভূগছিলেন তিনি। গত ২ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। জীবিতকালে মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় কোনোমতে চলতো তার চিকিৎসাসহ সংসারের ব্যায়ভার। মৃত্যুর পর থেকে আটকে আছে তার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা। প্রয়াত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গুলজার আলী সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের জিরারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। জীবিকা নির্বাহে উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় এখন চরম দূর্দিন নেমে এসেছে ওই পরিবারে। তাদের জীবনমান রক্ষার্থে প্রশাসনসহ সমাজের কেউই তাদের পাশে এগিয়ে না আসায় ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কিত রয়েছেন তারা। তার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গুলজার আলীর কোনো পুত্রসন্তান নেই। তার উত্তরসূরির মধ্যে রয়েছেন স্ত্রী ফুলেছা বেগম, দুই মেয়ে আফিয়া খাতুন ও রোকেয়া খাতুনসহ নাতি-নাতনীরা। মুক্তিযোদ্ধা গুলজার আলীর ছোট মেয়ে রোকেয়ার স্বামী অন্যত্র চলে যাওয়ায় তিন সন্তানসহ পিত্রালয়েই আছেন দীর্ঘদিন ধরে। চার সন্তানের জননী বড় মেয়ে আফিয়া খাতুনের বিয়ে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী গ্রামে। স্বামীর আর্থিক অবস্থাও খুবই খারাপ।
সম্প্রতি সরেজমিন জিরারগাঁও গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রয়াত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গুলজার আলীর জীর্ণশীর্ণ টিনসেডের একটি ঘর। তার স্ত্রী ফুলেছা বেগম কনিষ্ঠ মেয়ে রোকেয়া ও তার তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন ওই ঘরেই। সামান্য বসতভিটার ওপর ওই ছোট্ট ঘর ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই তাদের। অসুস্থ ফুলেছা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে অসুখে ভূগলেও টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছিনা। ঘরে খাবারও নেই। স্বামীর মৃত্যুর পর আজোবধি কেউ কোনো খোঁজখবর রাখেনি। লজ্জায় কারো কাছে হাতও পাততে পারছিনা। চারমাস ধরে স্বামীর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতাও আটকে আছে। ওই ভাতাটুকু পেলে অন্তত পরিবার পরিজন নিয়ে একটু স্বস্তি পেতাম। মেম্বার-চেয়ারম্যানও কোনো সাহায্য সহযোগিতা করেননি। তাদের কাছে গেলে বলে, তুমি মু্ক্তিযোদ্ধার বউ। সরকার মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করছে। ছোট্ট মেয়ের গর্ভের এক নাতি বেকারিতে চাকরি করছিল। মহামারী করোনায় তার চাকরিটাও বন্ধ। এখন ঋণ করে খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে বেচেঁ আছি। এসব দূর্দিনে আমাদেরকে দেখার কেউ নেই।’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গুলজার আলীর ভাতা পেতে ইতোমধ্যে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মহা পরিচালক বরাবর একটি লিখিত আবেদন জমা দেয়া হয়েছে। তার কল্যাণ ট্রাস্ট নং-২৪৭০৬, লাল মুক্তিবার্তা নং-০৫০২০৯০২২৪। এ ব্যাপারে দোয়ারাবাজার উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফর আলী বলেন, গুলজার আলী ছিলেন একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি আহত হন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেয়া হয়। কিন্তু যারা যুদ্ধাহত তাদেরকে ভাতা দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে। আমার জানামতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট নতুন নীতিমালা তৈরি করতে যাচ্ছে। আর ওই নীতিমালা বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে, যে কারণে গুলজার আলীসহ আরো অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা আটকে আছে। তাই এব্যাপারে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হলে গুলজার আলীর পরিবারকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার ভাতার আওতাভূক্ত করাটা সহজ হতো।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক, সিনিয়র আইনজীবী বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, ‘আমি প্রয়াত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গুলজার আলীর পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছি। তারা খুবই কষ্টে আছেন। কি কারণে তার ভাতা আটকে আছে জানিনা। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে একজন প্রয়াত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবার পরিজন না খেয়ে মরবে। আমি এই পরিবারটির পাশে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়সহ, প্রশাসন ও সমাজের হৃদয়বান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানাই।’ দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া সুলতানা বলেন, ‘প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা গুলজার আলীর পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে যোগাযোগ করেছি। তারা বলছে কাগজপত্র দেখে শিঘ্রই বিষয়টি আমাকে জানাবে।’